পেশাগত কারণে প্রায়ই ছুটে বেড়াতে হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, বিশেষ করে মফস্বল শহরগুলিতে। সরকারী ছুটি প্লাস উইকএন্ডের লম্বা সময়টাতে জামালপুর ঘুরতে যাওয়ার ডাক যখন পেলাম ইউনিভার্সিটির বন্ধু আরজু’র কাছ থেকে প্রথমে একটু দ্বিধার মধ্যেই পড়ে গিয়েছিলাম। আবার মফস্বল শহর। তারপর মনে হলো কেন নয়। প্রায় পাঁচ বছর আগে একবার জামালপুরে গিয়েছিলাম অফিসের কাজেই, কিন্তু শহর বা তার আশপাশ তেমনটা ঘুরে দেখা হয়নি। কাজ সেরে পরেরদিনই ঢাকা ফিরে এসেছিলাম। সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ (১৭৬০-১৮০০), হাতিখেদা বিদ্রোহ (১৭৭০-১৭৭৫) এবং পাগলপন্থী বিদ্রোহের (১৮২৫-১৮২৭) মতো আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু যে জামালপুর তা ঘুরেফিরে দেখার আগ্রহটা কিন্তু এই বেড়ানোর আগ পর্যন্ত মাথার ভেতর ঠিকই ঘুরপাক খাচ্ছিলো। তারমধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জামালপুরে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের বিরোচিত লড়াই যা ‘কামালপুরের যুদ্ধ’ নামে খ্যাত সেই কামালপুরের মাটি ছুঁয়ে দেখার একটা তীব্র ইচ্ছাও ছিল। তাই বন্ধু আরজু’র ডাক পাওয়ার সাথে সাথেই তৈরি হলাম জামালপুর যাব বলে। তৈরি হয়ে গেলো সাবেক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের ছোট একটা দল। আমরা ঠিক করলাম এবারের জার্নি হবে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে। দীর্ঘ বন্ধের কারণে রেলে টিকেট পাওয়া কঠিন। তবে সেটা ম্যানেজ হয়ে গেলো রেলের সাবেক কর্মকর্তা আমাদেরই বিশ্ববিদ্যালয়ের জুনিয়র ভাই রোকনের বদৌলতে। যারা শিরোনাম দেখে ভাবছেন, ভাই, ঘুরতে গেলেন জামালপুর আর লিখেছেন সন্ন্যাসীগঞ্জ, ব্যাপারটা কি? তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, জামালপুরের পুরোনো নাম সিংহজানী। এরপর এই এলাকা সন্ন্যাসীগঞ্জ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। এরসাথে হয়তো সন্ন্যাসী বিদ্রোহের একটা যোগাযোগ আছে। তাই হয়তো এই নামের স্মৃতি বয়ে বেরাচ্ছে শহরের আশেপাশেই থাকা সন্ন্যাসীর চর বা সন্ন্যাসীর ভিটা নামের এলাকাগুলি। সন্ন্যাসী বিদ্রোহের অবসানের প্রায় ৪৫ বছর পর ১৮৪৫ সালে জামালপুরের আবির্ভাব ঘটে প্রশাসনিক মহুকুমা হিসেবে। জামালপুর নামটি আবার করা হয়েছে সুফি হযরত শাহ জামাল (রঃ) স্মৃতিকে ধরে রাখার উদ্দেশ্যে। প্রচলিত রয়েছে এই সুফি ২০০ অনুসারীসহ ইয়েমেন থেকে এদেশে এসেছিলেন সম্রাট আকবরের শাসন আমলে। উদ্দেশ্য ধর্মপ্রচার। অল্পকিছুদিনের মধ্যেই তিনি আধ্যাতিক নেতা হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ব্রহ্মপুত্রের কোল ঘেঁসে সিংহজানী মৌজাতে তার ডেরা তৈরি হয়। ১৯৭৮ সালে জামালপুর আবির্ভূত হয় জেলা হিসেবে।

জামালপুর শহরের নামকরণ করা হয়েছে সুফি হযরত শাহ জামাল (রঃ) নামানুসারে। শহরেই রয়েছে এই সুফির মাজার।

ট্রেনের নাম তিস্তা

অনেকদিন পর রেল ভ্রমণ। যাওয়ার পথে আমাদের জন্য একটি এসি বার্থ কামরা রিজার্ভ করা হয়েছে। সকাল সাড়ে সাতটার ট্রেন ধরতে আমরা কমলাপুর পৌঁছলাম সাতটার সময়। ভয় ছিল গিয়ে দেখবো ট্রেন নেই। স্টেশনে ঢুকে দেখি ‘তিস্তা’ নামের ঝকঝকে ট্রেনটি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। কামরায় উঠে দেখি তা বেশ পরিচ্ছন্ন। রেলের আগের অভিজ্ঞতার সঙ্গে ঠিক মেলে না। দেশের সঙ্গে সঙ্গে যে রেল ব্যবস্থারও উন্নতি হয়েছে তা বলতেই হয়। সাড়ে সাতটার ট্রেন ছাড়লো সাড়ে আটটায়। আমরা দলে আড্ডা দিচ্ছিলাম বলে হয়তো এক ঘন্টার দেরিকে অতো দেরি মনে হলো না। ছাড়ার পর কিন্তু ‘তিস্তা’ আমাদের ঝামেলাবিহীনভাবেই চার ঘন্টার মধ্যে জামালপুর পৌঁছিয়ে দিলো। এই চার ঘন্টা আড্ডা চললো বিরামহীন। এর মাঝে আমরা অর্ডার দিলাম চা আর কাটলেটের। ট্রেনের কাটলেটটা আমাদের কাছে বিশেষ একটা ব্যাপার। ছোটবেলায় বেশ কয়েকবার রংপুর থেকে ফুলছড়ি-বাহাদুরাবাদ ঘাট হয়ে ঢাকা পর্যন্ত আন্ত:নগর ট্রেন জার্নি করেছিলাম। তখন এই কাটলেট ছিলো আমাদের জন্য বিশেষ আকর্ষণ। আমরা কাটলেটেরে অর্ডার দিয়ে যেন সেই শৈশবে ফিরে যেতে চেয়েছিলাম। তবে এখন স্বাদটা যেন একটু অন্যরকম লাগলো। স্বাদটায় কি পরিবর্তন এসেছে, নাকি সময়ের সাথে সাথে আমাদেরই জিহ্বার স্বাদ পাল্টে গেছে! আমরা ফিরেছিলামও ‘তিস্তা’য়। আসার দিন কিন্তু বিকাল চারটার ট্রেন চারটাতেই ছেড়েছিল এবং ঠিক সময়মতো আমাদের বিমানবন্দর স্টেশনে নামিয়ে দিয়েছিল। পুরো ভ্রমণের অভিজ্ঞতাটাই ছিল অনেক স্বস্তিকর।

ব্রহ্মপুত্রের কোলের শহর জামালপুর

নব্বই বছরের পুরোনো বিল্ডিংয়ের নিচ তলায় তামান্না হোটেলে আমরা সারলাম দুপুরের খাবার।

হোটেলে দ্রুত ‘চেকইন’ করার পর আমরা বেরিয়ে গেলাম জামালপুর শহরটা দেখতে। শহরের মূল রাস্তা একটাই। সেই রাস্তা ঘিরেই অফিস-আদালত-দোকানপাট। সে কারণে শহরটার আকার অনেকটা লম্বাটে। রাস্তার একদিকে শহর আর অন্যদিকে ব্রহ্মপুত্র নদ। নদ অবশ্য পানিতে ভরে ওঠে শুধু বর্ষার সময়ই।

দুপুরের খাবারের পরেই মিললো গরুর দুধের চা আর গরম গরম জিলাপি।

অন্য আর দশটা মফস্বল শহরের মতো জামালপুরের রাস্তাও ব্যাটারীচালিত অটোরিক্সার দখলে। আমরা একটা অটোরিক্সায় উঠে পড়লাম। গন্তব্য সার্কিট হাউস। পথে থামলাম ‘তামান্না রেস্টুরেন্ট’ এ দুপুরের খাবার খেতে। রেস্টুরেন্টটার বড় বৈশিষ্ট্য হলো এটি অবস্থান করছে একটি নব্বই বছরের পুরোনো বিল্ডিংয়ের নীচতলায়। ঢুকেই মনটা ভালো হয়ে গেল এর খোলামেলা পরিবেশের জন্য। রেস্টুরেন্টটার সামনে একটা ছোট্ট বাজার। বন্ধু আরজু জানালো সকালবেলা এখানে টাটকা সবজির বাজার বসে। সেই বাজারেই দেখি গরুর দুধের চা পাওয়া যাচ্ছে। দুপুরের খাবারের পর এই চায়ের চাইতে ভালো আর কি হতে পারে। সঙ্গে জুটে গেল মচমচে জিলাপী। একটু এগিয়ে সামনে দেখি একটা লম্বা কংক্রিটের ব্রিজ ব্রহ্মপুত্রের মধ্যে ঢুকে গেছে। ব্রিজের শেষপ্রান্তটা খোলা। দেখে মনে হয় যেন একটা জেটি। অপেক্ষা করছে কোনো জাহাজের জন্য। জানা গেল যে ব্রিজটা তৈরি শুরু হয়েছিল নদের ওপারের একটি গ্রামকে যুক্ত করার জন্য। কাজ শেষ হওয়ার আগেই সেই গ্রাম ভেঙ্গে যায় নদের স্রোতের তোড়ে। এখন এখানে ঘুরতে আসে শহরের মানুষজন।

ব্রহ্মপুত্র নদ – জামালপুর শহরের কোল ঘেঁষেই রয়েছে দাঁড়িয়ে।

নদের পাড়ের বিশুদ্ধ শীতল হাওয়াতে তাদের প্রাণ জুড়ায়। আমরা হেঁটে গেলাম ব্রিজের মাথা পর্যন্ত। দিগন্ত বিস্তৃত নীল আকাশ, কোথাও কোথাও কালো মেঘের দখল। একটু দূরে চরের মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে টিনের ঘরবাড়ি। ব্রিজের নীচে খালের মতো পানির স্রোত। তারই ধারে মাটির উপর পড়ে আছে কিছু নৌকা। যেন অপেক্ষা করছে কখন বর্ষা আসবে, কখন যৌবন ফিরে পাবে ব্রহ্মপুত্র। মন ভালো করা এই পরিবেশে কিছু সময় কাটিয়ে আমরা হাঁটতে থাকলাম নদের পাড়ের ফুটপাত দিয়ে। এই পথটাও সবুজে ভরা। সারি সারি জাম গাছ, সারি সারি সুপারী গাছ। মিনিট দশেক হাঁটার পর আমরা পৌঁছে গেলাম সার্কিট হাউসে।

বন্ধু আরজুর আমন্ত্রণে দলবেঁধে জামালপুর ঘুরতে যাওয়া।

সুলতাননগরের সুখদুঃখ – বাংলাদেশেরই প্রতিচ্ছবি

সার্কিট হাউজ থেকে বেরিয়ে আমরা রওনা হলাম বন্ধু আরজু’র গ্রামের বাড়ি সুলতাননগরের উদ্দেশ্যে। অটো, সিএনজি, তারপর রিকশা ভ্যানে করে প্রায় ৪৫ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম সুলতাননগর গ্রামে। অসাধারণ সুন্দর এই গ্রামের চারদিকে বিল। পুরো গ্রামটা গাছগাছালীতে ভরা। কয়েক বছর আগে গ্রামে ঢোকার রাস্তাটা পাকা হয়েছে। গ্রামে ঢুকেই নতুন ধানের গন্ধ পাওয়া গেল। ধান কাটামারি চলছে। বাতাসে তারই গন্ধ ম-ম করছে। প্রায় প্রতিটি বাড়িতে পালা করা ধানের স্তুপ। কোথাও ধান সিদ্ধ হচ্ছে, কোথাও ধান শুকানো হচ্ছে। আবার কোথাও ধান মাড়াই হচ্ছে মেশিনে। কোথাও দেখলাম কুলায় করে ধান উড়ানো হচ্ছে পাতান থেকে ধান আলাদা করার জন্য। সবার মুখে সুখের হাসি। ফসল ঘরে তোলার নির্মল সুখ। দেখে মনের অজান্তেই গেয়ে উঠতে ইচ্ছা করে, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।’ সবচেয়ে ব্যস্ত দেখলাম নারীদের। কেউ বসে নেই, কিছু না কিছু করছেই। অথচ কৃষিতে এই নারীদের অবদানের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি আমরা এখনো দিতে শিখিনি।

সুলতাননগরে তখন চলছিল ধান কাটামারি – বাতাসে নতুন চালের ম-ম গন্ধ।

একটু পরেই আমাদের পেছনে জড়ো হলো গোট দশেক উৎসুক বাচ্চা ছেলেমেয়ে। মুহূর্তেই ওদের সঙ্গে খাতির হয়ে গেল। জানলাম, সবাই স্কুলে যায়, কেউ কেউ স্থানীয় মাদ্রাসায় পড়ে। আমাদের আরজু যেন হ্যামিলনের বাঁশিওলা – ওর পেছনে পেছনে পুরো সময় ছুটলো এই বাচ্চাদের দল। আমরা আমাদের ক্যামেরায় ধরে রাখতে চাইলাম এদের হাসিমাখা মুখ। এরাই তো আমাদের ভবিষ্যত।

আমাদের আরজু যেন হ্যামিলনের বাঁশিওলা – ওর পেছনে মুহূর্তে জড়ো হয়ে গেল একদল শিশু।

শেষ বিকেলে আমরা চলে গেলাম বিলের পাড়ে। বিলের স্থানীয় নাম ‘বামুনজি’। বিলের ধারে ধানক্ষেত। কোনো কোনো ক্ষেতে সবে ধান কাটা হয়েছে। মোথায় ভরা ন্যাড়া মাঠগুলো সেই স্বাক্ষ্য বহন করছে। অনেক ক্ষেতেই ধান পাকা শুরু হয়ে গেছে। পাকা ধানের সোনালি আভা আর সবুজের সম্মিলনে নতুন এক ঘোরলাগা রং তৈরি হয়েছে। দেখলাম নৌকায় করে মানুষজন বিল পাড়ি দিচ্ছে নিজের ঘরে পৌঁছবে বলে। নৌকায় করে জাল বিছিয়ে মাছ ধরছে কিছু মানুষ। একদল হাঁস লাইন ধরে রওনা দিয়েছে গৃহস্তের ঘরে ফিরবে বলে। সূর্যাস্তটা আমরা উপভোগ করলাম বিলের ধারে। ক্লান্ত লাল সূর্য টুপ করে ডুবে গেল বিলের জলে নান রঙের আভা তৈরি করে। বাংলাদেশের একটা পরিপূর্ণ সুখী গ্রামের চিত্র পেলাম সুলতাননগরে এসে।

বামুনজি বিলের ধারে সূর্য ডোবা উপভোগ করা গেল।

আমরা যখন গ্রামের রাস্তা দিয়ে ঘুরছি, অনেক মুরুব্বি এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন, “তোমরা কারা বাবা? কোনখান থাইকা আইছ? সরকারী লোক নাকি?” আমাদের দলের তিনজনার হাতে ডিএসএলআর ক্যামেরা, যা পাচ্ছি তারই ছবি তুলছি। আমরা যখন জানালাম যে আমরা আরজু’র বন্ধু, এসেছি গ্রামটা ঘুরে দেখতে, তখন প্রত্যেকের মুখেই স্বস্তি লক্ষ্য করলাম। আরজু’র কাছে যখন জানতে চাইলাম কেন সবাই আমাদের সরকারী লোক ভাবছে, তখন শুনলাম আরেক গল্প। সুলতাননগরের দুঃখের গল্প। গ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে পাকা রাস্তা ঘিরে সরকার পরিকল্পনা করেছে ‘ইকোনোমিক জোন’ করার। এজন্য ওই এলাকার জমি অধিগ্রহণ চলছে। বিলসংলগ্ন ৯০ একর খাসজমি ইতোমধ্যেই প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ২২৭ একর বিলটির এখন অবশিষ্ট আছে ১৩৭ একর। গ্রামবাসীদের এ নিয়েও তেমন কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু ঠিকাদার সংস্থা যেভাবে বিল থেকে বালু তোলার পরিকল্পনা করছে, তাতে ‘বামুনজি’ বিলের জীব-বৈচিত্র্যের বারোটা তো বাজবেই, এমনকি বিলের মধ্যে বিলীন হয়ে যেতে পারে আশেপাশের পাঁচটি গ্রামের ঘরবাড়ি। গ্রামবাসীরা চান জমি ভরাটের বালু সংগ্রহ হোক অন্য কোথাও থেকে। এ নিয়ে তারা জেলা প্রশাসকসহ অনেকের কাছেই স্মারকলিপি দিয়েছেন, কিন্তু কোনো ফল পাচ্ছেন না। তারা সবাই নিজেদের গ্রামগুলির বিপন্নতা নিয়ে চিন্তিত। কথা হচ্ছিলো কয়েকজন গ্রামবাসীর সঙ্গে, তারা বলছিলেন, “আমরা তো এখন ভালোই আছি। কৃষকদের গোলাভরা ধান আছে। কৃষিশ্রমিকেরা প্রতিদিন মজুরি পাচ্ছে ৫০০ টাকা। ‘বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা’ হলে আমাদের নতুন আর কি সুবিধা হবে?” দেশের এবং জামালপুর জেলার বৃহত্তর স্বার্থে তারপরও তারা এই প্রকল্পের বিরোধী নন। তারা শুধু চান বিলের যেন কোনো ক্ষতি না হয়। বিলের ওপর নানাভাবে নির্ভরশীল পাঁচ গ্রামের হাজার হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা, ঘরবাড়ি এবং জমিজমা যাতে কোনোভাবেই বিপ‍র্যস্ত না হয়, সে জন্যই তারা চান যেন বিল থেকে বালু তোলা না হয়। ভাবছিলাম, এতো খুবই মৌলিক চাওয়া।গ্রামবাসীকে এটি চাইতে হবে কেন? যারা উন্নয়ন পরিকল্পনা করেছেন, তাদের মূল ভাবনাতেই তো এটি থাকার কথা। কবে যে স্থানীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় স্থানীয় জনগণের মতামত গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হবে?

যে বিলকে ঘিরে ৫০০০ মানুষের জীবন ও জীবিকা সেই বিল টিকে থাকতে পারবে তো? উন্নয়ন ভাবনায় স্থানীয় মানুষজনের মতামত নেয়া কবে যে বাধ্যতামূলক করা হবে?

সন্ধ্যা গড়িয়ে যখন রাত হলো, পরিস্কার আকাশে তখন বড় একটি চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। আরজু তাদের বাড়ির উঠানে আমাদের জন্য পাটি বিছিয়ে দিল। আমরা সেখানে গা এলিয়ে খোলা আকাশের নীচে চাঁদ উপভোগ করছি। রাতে খাবারের আয়োজন হলো স্থানীয় বিভিন্ন আইটেম দিয়ে। খাবারের স্বাদে আমরা অভিভূত। আমাদের সফর সঙ্গী খাদ্যরসিক পুরান ঢাকার পোলা শাকিল বললো, স্বাদ তো হবেই, একে তো সব টাটকা জিনিস, তার ওপর আবার খড়ির চুলায় রান্না। আমরা পরিচিত হলাম, ‘ম্যান্দা’ নামের স্থানীয় এক খাবারের সঙ্গে। গরুর মাংসের সঙ্গে চালের গুড়া দিয়ে বানানো আইটেম। ঝোলটা অনেক ভারি। স্বাদটা অনেকটা হালিমের মতো, কিন্তু আবার হালিমও না। উত্তরাঞ্চলে গ্রাম্য মজলিসের মাংসের তরকারীতে আটা মেশাতে দেখেছি। এখানে দেখলাম মেশানো হয়েছে চালের গুড়া। রাতের খাবার সেরে যখন শহরে ফেরার জন্য রওনা দিলাম, আমাদের মুখে তখনও লেগে আছে ‘ম্যান্দা’র স্বাদ। ফেরার পথে দেখি বাজারে গ্রামবাসীদের বড় জমায়েত হচ্ছে। সবাই একত্রিত হয়ে আলোচনা করছে বিল রক্ষায় কি করা যায়। সমষ্টিগত এই প্রচেষ্টা দেখে ভালো লাগলো। আশা করি, প্রশাসনের বোধোদয় হবে। পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় অন্ধকার দূর হবে। মনুষ্য-সৃষ্ট দুঃখের শিকার হতে হবে না সুলতাননগরবাসীদের। সুখী সুলতানপুরের সবাই সুখেই থাকবে সকলে মিলে।

সুজলা সুফলা সুলতাননগরের মানুষগুলো সুখে থাক সব সময়।

মধুটিলায় গারো পাহাড়ের হাতছানি

পরের দিন সকালে আমরা বের হলাম শেরপুরের উদ্দেশ্যে। আগস্ট মাসের আলোকিত সকাল। ভাড়া মাইক্রোবাসে করে আমরা যখন পাকা রাস্তায় চলছি, চারদিকে তাকিয়ে মন ভালো হয়ে গেল। আমার কাছে ধানকাটার আগের বাংলাদেশের গ্রামবাংলার প্রকৃতি সবচেয়ে সুন্দর লাগে। মাঠগুলো সবুজ ধানক্ষেতে ভরা থাকে। হালকা পাতলা বৃষ্টি ধুয়ে সতেজ করে তোলে গাছগাছালি। আমাদের গাড়ি ছুটে চললো এরকম এক রাস্তা ধরেই। দুধারে ধানক্ষেত। কোনো কোনো ক্ষেতে ধান পাকা শুরু হয়েছে। ফলে সবুজের মাঝে যেন হালকা সোনালী রঙের তুলির টান দিয়ে রেখেছে কোনো চিত্রকর। প্রায় দেড় ঘন্টা পর আমরা পৌঁছালাম মধুটিলা ইকো পার্কে।

প্রকৃতি আর নির্জনতা মধুটিলা ইকো পার্কের আসল আকর্ষণ।

আমাদের ড্রাইভার জানালো যে, মধুটিলা ইকো পার্ক পিকনিক স্পট হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। পিকনিক সিজনে নাকি ভীড়ের কারণে এখানে ঢোকাই মুশকিল। এটা অবশ্য এখন আমাদের দেশের প্রায় সব পিকনিক স্পটের জন্যই প্রযোজ্য। গারো পাহাড়ের পাদদেশে ৩৮৩ একর আয়তনের এই পার্কের বড় আকর্ষণ হলো প্রকৃতির মাঝে নির্জনতা। সবুজের মাঝে নির্জনতা আর নিস্তব্ধতা উপভোগের চাইতে আনন্দের বিষয় আর কিই বা হতে পারে! যেন স্তব্ধতার গান শোনা। শেরপুরের নালিতাবাড়ি উপজেলার এই ইকো পার্কে কিন্তু ওষধি গাছের এক বিশাল সংগ্রহ রয়েছে। তাও আবার ২০ একর জায়গা জুড়ে। বাংলাদেশ বন বিভাগকেও ধন্যবাদ দিতে হয় সুন্দর ব্যবস্থাপনার জন্য। লেকটাও দেখলাম বেশ গুছানো। এমনকি লেকে নৌকাভ্রমণের ব্যবস্থা আছে। দেশি এবং পেডাল – দুই অপশনই আছে। তবে পিকনিকের সিজনে এখানকার পরিবেশ কেমন থাকে তা বলা কঠিন।

সবুজ বনের ওপরে দূর থেকে হাতছানি দেয় গারো পাহাড়।ো

একটু ঘোরাঘুরি করতেই আমাদের নজরে পড়লো পার্কের মাঝে থাকা ওয়াচ টাওয়ার। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে খানিকটা কষ্ট হলো। সবাই দরদরে ঘামছিলাম। কিন্তু যখন টাওয়ারের উপর থেকে চারদিকে তাকালাম, কষ্টকে আর কষ্ট বলে মনে হলো না। দূরে গারো পাহাড়ের হাতছানি। চারদিকে সবুজ আর সবুজ। উপরে দূরের দৃশ্য দেখার জন্য দূরবীনের ব্যবস্থা আছে। টাকা দিয়ে সেগুলো ব্যবহার করা যায়। শুনলাম এই বনের একটা অংশ নাকি ভারত অংশেও বিস্তৃত। নিচে ঘোরাঘুরির সময় পুরো পার্কের বিস্তৃতি বোঝা যায় না। বোঝা যায় না সবুজের সমারোহটাও।

দূরবীন দিয়ে দূরের দৃশ্য দেখার ব্যবস্থাও আছে ওয়াচ টাওয়ারে।

টাওয়ার থেকে নিচে নেমেই আমরা দেখা পেলাম এক ডাবওলার। যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। সবাই অনেকটা ঝাঁপিয়েই পড়লাম তৃষ্ণা মেটাতে। পাশে পেলাম গরম গরম পিয়াজু। সঙ্গে মিললো চা। সব মিলিয়ে সকালের শেষভাগের চা বিরতিটা খারাপ হলো না। বের হবার পথে পার্কের উঁচু ঢাল বেয়ে ওঠার সিঁড়িতে বসে সদলবলে সময় কাটালাম। সময়টা ধরে রাখার জন্য তোলা হলো বেশকিছু গ্রুপ ছবি। পার্কে একটা গেস্ট হাউসও আছে। তবে সেখানে রাত কাটাতে হলে প্রশাসন থেকে অনুমতি নিতে হয়। এখানে পূর্ণিমার রাতে এসে থাকতে পারলে দারুণ একটা অভিজ্ঞতা হতো।

গরমের মধ্যে ডাবের পানি আমাদের তৃষ্ণা মেটালো।

ভোগাই নদীর কোল-ঘেঁষা ছিমছাম নাকুগাও স্থলবন্দর

মধুটিলা থেকে বেরিয়ে আমরা ছুটলাম নাকুগাও স্থলবন্দর বন্দরের দিকে। শেরপুরে যে একটা স্থলবন্দর রয়েছে এবং তার সাথে ইমিগ্রেশন চেকপোস্টও আছে তা আমার জানা ছিল না। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার এটা চালু করতে আগ্রহী হয়েছিল মূলত: ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরির বিষয়টা মাথায় রেখে। এখন এবন্দর দিয়ে কয়লা আর পাথর আমদানি হয় আর সিমেন্ট রপ্তানি হয়। ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট দিয়ে মানুষ পারাপারের ব্যবস্থা থাকলেও খুব বেশি মানুষ এপথ দিয়ে যাতায়াত করে না।

ছিমছাম স্থলবন্দর বন্দর নাকুগাঁও।

এবন্দর দিয়ে যাতায়াত কিন্তু তুলনামূলকভাবে অনেক সহজ। ইমিগ্রেশনে ভীড় নাই। নাই দালালদের আধিপত্য। সীমান্ত পেরিয়ে তিন কিলোমিটার গেলেই বাস স্ট্যান্ড। সেখান থেকে বাসে করে সরাসরি যাওয়া যায় আসামের গোয়াহাটি বা পশ্চিম বঙ্গের শিলিগুড়ি। পূর্বদিকে গেলে গোয়াহাটি আর শিলং। আর পশ্চিমে গেলে শিলিগুড়ি। মিজোরাম, অরুণাচল এবং নাগাল্যান্ড যাওয়ার সহজ পথ উত্তরের মানুষের জন্য এটিই। তাছাড়া, গোয়াহাটিতে থাকা বিমানবন্দর ব্যবহার করে যাওয়া যায় ভারতের সব বড় শহরগুলোতেই। চিন্তা করুন, ঢাকা থেকে ৪/৫ ঘন্টায় নাকুগাও। তারপরেই ভারত। তারপরও প্রচারের অভাবে অনেকটা অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে নাকুগাও চেকপোস্ট। এই চেকপোস্ট দিয়ে সড়কপথে ভারতে ঢুকতে ভিসার আবেদনে উল্লেখ করতে হয় ‘বাই রোড ডালু’। ভারতের অংশে ‘ডালু’ হলো এই চেকপোস্টের নাম। আমার শিলং যাওয়ার পরিকল্পনা আছে। যদি চালু থাকে তাহলে আমি হয়তো এই পথেই শিলং যাব।

ভোগাই নদী থেকে বালু তোলায় ব্যস্ত বেশ কিছু শ্রমিক।

নাকুগাও আমার দেখা সবচেয়ে ছিমছাম স্থলবন্দর। কম ব্যস্ত বলেই হয়তো এটা মনে হয়েছে। বন্দরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ভোগাই নদী পুরো পরিবেশে একটা ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। শিলংয়ের পাহাড়ি নদী তুরা হলো ভোগাইয়ের পানি প্রবাহের উৎস। নদীতে বালু তোলার কাজে ব্যস্ত অনেক শ্রমিক। বাঁশের মাচার মতো পানির ওপরে ভেসে থাকা স্থাপনায় সংগৃহীত বালু রাখা হচ্ছে। সবচেয়ে ভালো কোয়ালিটির এই বালু ট্রাকে করে চলে যাবে দেশের বড় বড় শহরে। আমরা জুতা খুলে সবাই নেমে পড়লাম পানিতে। নদীর ঠান্ডা পানি শরীরে লাগার সঙ্গে মনে হলো যেন আমরা পাহাড়ি ঝর্ণার পানিই স্পর্শ করছি। শরীরের ক্লান্তি কিছুটা যেন দূর হলো। একটু মনও খারাপ হলো এই ভেবে যে একই নদীর পানি বিছিন্ন দুই দেশে। একই জল, একই পানি। মাঝে সীমান্ত রেখা। অথচ এই পানি একটু এগিয়ে গিয়ে স্পর্শ করতে গেলে লাগবে পাসপোর্ট, লাগবে ভিসা। ১৯৪৭ সালে একজন সাহেবের টানা রেখায় ভাগ হয়ে গেছে নদী, বন, জল ও জঙ্গল।এ হলো দেশ ভাগের রাজনীতির ফসল!

লাউচাপড়ায় সবুজের সমারোহ

নাকুগাও থেকে লাউচাপড়া যাওয়ার রাস্তাটা সম্ভবত বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর রাস্তাগুলোর একটি। দু’ধারে ছোট ছোট টিলা আর বন, পেঁচানো আর সরু রাস্তায় চললে মনে হয় অন্য বাংলাদেশ দেখছি।

নাকুগাও থেকে বেরিয়ে আমরা ছুটলাম জামালপুরের বকশীগঞ্জের দিকে। উদ্দেশ্য লাউচাপড়া পাহাড়িকা অবকাশ কেন্দ্র ঘুরে দেখা। আমাদের মাইক্রোবাস এবারে ছুটলো বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর রাস্তাগুলোর একটি দিয়ে। দু’ধারে ছোট ছোট সবুজ টিলা। মাঝে মাঝেই বন। পেঁচানো, পরিচ্ছন্ন এবং কম ব্যস্ততাপূর্ণ এই রাস্তায় উঠে মনে হলো আমরা অন্যরকম সুন্দর বাংলাদেশ দেখছি। পথে পথে আবার দেখি হাতি ক্রসিংয়ের সাইন। জেব্রা ক্রসিং, ডিয়ার ক্রসিংয়ের পর এবার সড়কে এলিফ্যান্ট ক্রসিংয়ের সাইন দেখার অভিজ্ঞতাও যোগ হলো।

সাবধান! পাশেই হাতির বিচরণ এলাকা।

লাউচাপড়া ‌অবকাশ কেন্দ্রও আসলে একটা পিকনিক স্পট। আর দশটা স্পটের মতো এখানকার প্রবেশ পথটাও ট্যুরিস্টিক। মূল গেট ধরে একটু হাঁটলে পাওয়া যায় ওয়াচ টাওয়ারে ওঠার ঢাল। সেই ঢাল উঠতে হয় সিঁড়ি বেয়েই। মধুটিলার মতো এই টাওয়ারও ‌অনেক উঁচু। এবার আমাদের দলের দুএকজন ওঠার কষ্টের কথা ভেবে ক্ষান্ত হলো। কিন্তু তারা জানতেই পারলো না যে কি ভীষণ সুন্দর অভিজ্ঞতা তারা মিস করলো। টাওয়ারের সবচেয়ে উঁচু তলায় উঠে চারিদিক তাকিয়ে দেখি সবুজ আর সবুজ। মনে হচ্ছিলো যেন বেলুনে চড়ে সবুজের ওপর ঘুরে বেরাচ্ছি। দ্রোণ ব্যবহার করে উঁচু থেকে বনের ছবি তুললে যেমন লাগে অনেকটা সেই রকম অনুভুতি। যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজে ভরা – এ যেন সবুজের সমারোহ। দূরে মেঘালয়ের পাহাড় যেন আকাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের ডাকছে। এই ডাকে সাড়া দিয়েই শিলং যেতে হবে মনে হচ্ছে। বন থেকে ভেসে আসছে পরিচিত আর অপরিচিত পাখপাখালির ডাক। স্থানীয়রা বললেন, ধান পাকার মওসুমে রাতে মেঘালয়ের পাহাড় থেকে নেমে আসে হাতির দঙ্গল। তছনছ করে দিয়ে যায় পাকা ফসল। গ্রামবাসীদের তখন দলবেঁধে ক্ষেত পাহারা দিতে হয়। হাতির দল লোকালয়ে নেমে আসে কারণ বন এবং বনের খাবার সাবাড় করেছে মানুষ। মানুষ আর হাতির অস্তিত্বের এই লড়াই চলছে সারা বিশ্ব জুড়েই। বিশ্বজুড়ে আমাদের মতো মানুষের সর্বগ্রাসী ক্ষুধায় বিপর্যস্ত বনবাদাড়, হাতিরাও এর ব্যতিক্রম না। হাতি আর মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান তখনই সম্ভব হবে যখন মানুষের সর্বগ্রাসী এই ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে।

টাওয়ারের ওপর থেকে তাকালে চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। এ যেন সবুজের ওপরে ভেসে থাকা।

টাওয়ার থেকে নেমে আমরা কৃত্রিমভাবে তৈরি করা লেকের পাশে গাছের নিচে বসে পড়লাম। ছিমছাম এই জায়গা বিশ্রামের জন্য দারুণ। এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ছোটার কারণে আমাদের দুপুরে খাওয়ার সুযোগ হয়নি। গাছের নিচে পেয়ে গেলাম স্থানীয় এক নারীর ছোট্ট দোকান। সেখানে মিললো ঝালমুড়ি আর বিস্কুট। হাল্কা নাস্তা সারতে সারতেই বন্ধু আরজু জানালো পাশেই ‘দিকলাকোনা’ নামে গারোদের গ্রাম। সেখানে তার এক বন্ধু থাকে। আমরা সবাই লাফিয়ে উঠলাম সেখানে যাওয়ার জন্য।

ছিমছাম গারোদের সবুজ গ্রাম দিকলাকোনায় আমাদের বিকালটা ভালোই কাটলো।

অবকাশ কেন্দ্র থেকে ঢালু পথ ধরে নেমে এলাম দিকলাকোনায়। গারোদের এই গ্রামে ২২ পরিবারের বাস। জনসংখ্যা প্রায় ১শ। আমরা আরজুর বন্ধুর দেখা পেলাম না। কিন্তু দেখা পেলাম মনমুগ্ধকর প্রাকৃতিক পরিবেশের। গ্রামটা কতগুলো টিলার মাঝে বিদ্যমান সমতল ভূমির ওপর দাঁড়িয়ে। চারদিকে সবুজ ধানী জমি। টিলাগুলোর চারধারে সবুজ গাছপালা। এরই মধ্যে সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়তে শুরু করেছে। আলোছায়ার মায়াবী রূপ খেলা করছে চারিধারে। একই সঙ্গে অনুভব করলাম শীতল বাতাস। সারাদিনের ছোটাছুটির পর বাতাসের এই শীতল স্পর্শ আমাদের ক্লান্তি দূর করে দিল। গ্রামের রাস্তার ধারে থাকা বাঁশের মাচাংয়ে আমরা বসে পড়লাম। পাশেই একটা ছোট্ট দোকানে ভাজা হচ্ছিলো পিয়াজু। ছিল চায়ের ব্যবস্থা। এমন সুন্দর পরিবেশে সবাই মিলে গল্প আর আড্ডা দেয়ার চাইতে আনন্দের বিষয় আর কি হতে পারে? কোলাহল আর দূষণবিহীন এক গ্রামে অলস বিকেল। ক্ষেতে দুএকজন গারো নারীপুরুষ কাজ করছে। জমির মাঝের রাস্তায় খেলছে শিশুরা। তাদের মধ্যে নেই কোনো ব্যস্ততা। ঢাকা শহরে জ্যাম, বায়ু আর শব্দ দূষণের মাঝে দিনের পর দিন কাটানোর পর এই বিকাল পুরো অন্য এক অভিজ্ঞতা।

সূর্য হেলে পড়তে শুরু করেছে পশ্চিম দিকে। টিলার মাঝে থাকা সমতলে সবুজ ধানী জমি। আলোছায়ার মায়াবী খেলা আমাদের মুগ্ধ করলো।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত কামালপুর

দারুণ এক বিকেলের শেষভাগে আমরা রওনা দিলাম কামালপুরের দিকে। কামালপুর – আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে যে নাম ওতোপ্রোত:ভাবে জড়িয়ে আছে। ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বরে বীর মুক্তিযোদ্ধারা ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সহায়তায় পাকিস্তানী বাহিনীর কামালপুর দুর্গের পতন ঘটায়। সেটা ছিল বাংলার মাটিতে পাকিস্তানী নিয়মিত বাহিনীর প্রথম আত্মসমর্পনের ঘটনা। কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ কামালপুর ব্যারাকের দায়িত্বে ছিল পাকিস্তানী বাহিনীর ১৪তম ডিভিশনের সৈন্যরা। আর মুক্তি বাহিনীর মূল লক্ষ্য ছিল এই ব্যারাকের পতন ঘটিয়ে জামালপুর-টাঙ্গাইল রুট ধরে ঢাকার দিকে অগ্রসরের পথ পরিস্কার করা। পাকিস্তানীরা জানতো এই পথে নদীর প্রতিবন্ধকতা কম। ফলে মিত্র বাহিনী এদিক দিয়ে ঢুকে পড়লে তা তাদের জন্য সমূহ বিপদ তৈরি করবে। যুদ্ধের শুরুর দিকে নিয়াজী নিজেই এই ব্যারাক তদারকী করতো। আর এই ব্যারাকের পতন ঘটেছে চতুর্থ প্রচেষ্টার পর। মুক্তি বাহিনী প্রথম এই ব্যারাক আক্রমণ করে ৩১ জুলাই। পাকিস্তানীদের তুমুল প্রতিরোধের কারণে সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। শুধু সেই সম্মুখ লড়াইয়েই ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।এটি এতই শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল যে এই ঘাঁটিতে সর্বমোট ৪ বার মুক্তি বাহিনী আর পাক সেনাদের মধ্যে সরাসরি সেটপিস যুদ্ধ বা সম্মুখ লড়াই হয়েছে (৩১ জুলাই, ২২ অক্টোবর, ১৪ নভেম্বর, ২৪ নভেম্বর)। ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত হিট অ্যান্ড রান বা গেরিলা লড়াই হয়েছে মোট ২০ বার। পুরো মুক্তিযুদ্ধে কামালপুর অভিযানে সর্বমোট ১৯৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। আহত হয়েছেন অসংখ্য। অন্যদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩১ বালুচের একটি কোম্পানির কমান্ডার মেজর আইয়ুব সহ ২২০ জন সেনা নিহত হয়েছেন।বীর উত্তম থেকে বীর প্রতীক মিলিয়ে সর্বমোট ২৯ জন মুক্তিযোদ্ধা সাহসিকতা পদক পেয়েছেন কেবল কামালপুর যুদ্ধের জন্যই। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এমন উদাহরন আর একটিও নেই (তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া)।

কামালপুরের বিজয় স্তম্ভের লাল সূর্য আমাদের জাতীয় পতাকার লাল রঙকে মনে করিয়ে দেয়।

বিকালের শেষভাগে আমরা পৌঁছালাম কামালপুরে। বাজার পার হয়ে যেতেই চোখে পড়লে শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্য নির্মিত স্মৃতি স্তম্ভ। মেঝেটা কালো টাইলসে মোড়ানো। সাদা দেয়ালের ভেতর বাংলাদেশের ম্যাপ। পাশেই দেয়াল জুড়ে অনেকগুলো ছিদ্র। যেন গুলি এসে উড়িয়ে দিয়ে গেছে। কামালপুরের যুদ্ধ এবং বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাস এভাবেই ধারণ করে আছে শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ। আরেকটু এগিয়ে গিয়ে দেখা পেলাম ধানুয়া-কামালপুর স্মৃতি স্তম্ভ। লাল আর সাদা রঙের ব্যবহার স্মৃতি স্তম্ভটিকে অনন্যতা দান করেছে। স্তম্ভের মাঝে থাকা লাল সূর্য একদিকে যেমন আমাদের জাতীয় পতাকার লাল সূর্যকে মনে করিয়ে দেয় আরেক দিকে মনে করিয়ে দেয় রক্তাক্ত সংগ্রামর মাধ্যমে জয় করা কামালপুরের কথা। নিজের ‌অজান্তেই গুনগুনিয়ে গাইতে থাকি,

“পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে

রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল।”

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধরে রাখা হয়েছে ম্যুরাল চিত্রে।

পেছনের দেয়ালজুড়ে আছে মুক্তিযোদ্ধাদের ম্যুরাল। আছে বঙ্গবন্ধু এবং আছে বাংলাদেশের পরম বন্ধু ইন্দিরা গান্ধীর ম্যুরাল। কামালপুর যুদ্ধে শহীদদের তালিকাও রয়েছে এই স্মৃতি স্তম্ভে। আমরা সবাই চুপচাপ সময় কাটালাম শহীদদের শ্রদ্ধার উদ্দেশ্যে। এরকম একটা জায়গায় না এসে ঢাকায় ফিরে গেলে এঅঞ্চলের ইতিহাসের স্বাক্ষী হওয়ার সুযোগ হারাতাম। আমরা সবাই মিলে ধন্যবাদ জানালাম আরজুকে। মনে হতে থাকলো কত ত্যাগ ও তিতীক্ষার মধ্য দিয়ে আমরা অর্জন করেছি বাংলাদেশ নামের এই রাষ্ট্র। আমরা অনেক সময়ই হয়তো ভুলে যাই এই সংগ্রামের কথা। ভুলে যাই দেশকে দেয়ার দায়িত্ব আমাদের সবার। শহীদদের সম্মান জানানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হলো দেশের আর দশের কল্যাণের জন্য কাজ করা। নাগরিক হিসাবে নিজের দায়িত্বটা ঠিকভাব পালন করার। দিনকে বিদায় দিয়ে সূর্য ডুবে গেলো কামালপুরে। অন্য ধরনের এক ভালো লাগা আর দেশের প্রতি বাড়তি দায়িত্ব বোধ নিয়ে আমরা রওনা দিলাম জামালপুরের পথে।

কালো মেঝে, সাদা দেয়ালে মানচিত্র আর গুলিতে বিদ্ধ দেয়াল বাংলাদেশের জন্মের ইতিতাসেরই শৈল্পিক উপস্থাপন।
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments