মাত্র ১৯ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ছোট্ট দ্বীপ রটনেস্ট আইল্যান্ড। বিশাল অস্ট্রেলিয়ার মানচিত্রে দ্বীপটিকে তো খুঁজেই পাওয়া যায় না। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার পার্থ শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার পশ্চিমে ভারত মহাসাগরের বুকে জেগে থাকা দ্বীপটির নাম আগে কখনো শুনি নাই। ২০১৮ সালে যখন পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম যাই, তখন লুবনার ছোট বোন রুবিনা দ্বীপটিতে ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে। আমাদের মতো বাংলাদেশীদের কাছে দ্বীপ মানেই সেন্ট মার্টিনস। গাড়িতে করে সেই টেকনাফ যাওয়া, তারপর ছোট জাহাজে করে দ্বীপে পৌঁছানো। রুবিনার কাছে রটনেস্ট দ্বীপের কথা শুনেই গুগলের শরণাপন্ন হলাম। দ্বীপের ইনফর্মেশন পেজে দেখি বড় করে লেখা, রটনেস্ট হলো জীবনের সহজ আনন্দ। রুবিনার নেতৃত্বে সেই সহজ আনন্দের খোঁজে ছুটলাম লুবনা, শ্রেয় আর আমি।

রটনেস আইল্যান্ডের তথ্যকেন্দ্র

সেন্ট মার্টিনস দ্বীপের মতো রটনেস্ট আইল্যান্ডে যেতেও ফেরিতে উঠতে হয়। আসলে ফেরিতে যেতে না হলে সেটা দ্বীপই বা হয় কি করে! ৩০ মিনিট পরপর ফেরি রয়েছে। ৬ মার্চ সকালবেলা হেলতে দুলতে রেডি হয়ে আমরা যখন রকিংহ্যাম সিটি থেকে ড্রাইভ করে পার্থের ফ্রিম্যান্টল পোর্টে পৌঁছালাম তখন সকাল সাড়ে দশটা। ফেরির টিকিটের জন্য বিশাল লাইন। আমরা যখন কাউন্টারে পৌঁছালাম ততক্ষণে ফেরি রওনা দিয়ে দিয়েছে। পরের ফেরি ধরে রটনেসে পৌঁছালে ঘোরাঘুরির জন্য পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যাবে না। কাউন্টার থেকেই বুদ্ধি দিল পরের দিন সকাল সকাল রওনা দেয়ার। আমাদেরও মনে হলো সেটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তবে তখনই পরের দিন সকালের প্রথম ট্রিপের টিকেট কেটে নিতে ভুল করলাম না। ৭ মার্চ সকালে আমরা আবার উপস্থিত হলাম ফ্রিম্যান্টল পোর্টে এবং সরাসরি দাঁড়ালাম ফেরিতে ওঠার লাইনে। ফেরিতে ওঠার লাইন বেশ বড় হলেও উঠতে কোনো সমস্যা হলো না। আমাদের ফেরি সার্ভিসের নাম “রটনেস্ট সি ঈগল এক্সপ্রেস”। বেশ ঝকঝকে গোছানো ফেরি। ওঠার পরে মনে হচ্ছিলো না এতো মানুষ ফেরিতে উঠেছে। রটনেস্ট আইল্যান্ডে প্রতি বছর প্রায় ৭ লাখ ৮০ হাজার পর্যটক বেড়াতে যায়। আর এরা সকলেই ফেরিতে করেই পৌঁছান। ফলে ফেরি তো মানুষে ভর্তি থাকেই। কিন্তু সেটাও হিসাবের মধ্যেই থাকে। আমরা চারজন একটা বসার জায়গা পেয়ে গেলাম। ভারত মহাসাগরের নীল পানি ঠেলে যখন “রটনেস্ট সি ঈগল এক্সপ্রেস” চলা শুরু করলো। আমরা পেলাম সাগরের হাওয়ার স্পর্শ। পার্থে মার্চের রৌদ্রালোকিত দিন মানে বেশ চনমনে গরম। শুষ্ক এই পরিবেশে সাগরের হাওয়া আমাদের সহজ আনন্দের উপলক্ষ তৈরি করে দিল। আমরা কফি কিনে এনে উপভোগ করতে লাগলাম মহাসাগরের বুক চিরে আমাদের চলা।  ফেরির সবাই ছুটি কাটানোর মুডে। বেশির ভাগ মানুষই বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে পারিবারিক সময় কাটানোর উদ্দেশ্যে রটনেস্টে যাচ্ছেন। ফেরির একপ্রান্তে দেখা গেল অনেক বাইসাইকেল রাখা। দ্বীপে পৌঁছানোর পরে বুঝেছি কেন এরা বাইসাইকেল এনেছে। বাইসাইকেলে চড়ে পুরো দ্বীপ চষে বেড়ানোর মজাই আলাদা। দ্রুত গতির “রটনেস্ট সি ঈগল এক্সপ্রেস” আমাদের প্রায় পয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যেই নামিয়ে দিল জেটিতে।

রটনেস্ট এক্সপ্রেস ফেরির সামনে লুবনা আর রুবিনা

জেটিতে নেমেই রটনেস্টের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গেলাম । ছিমছাম পরিবেশ। তেমন ব্যস্ততা নেই। নেই ছুটে চলার তাগিদ। নীল সমুদ্র আর নীল আকাশে সাদা মেঘের ঘোরাঘুরি। এরকম আকাশ দেখলেই আমার বাংলাদেশের শরৎকালের কথা মনে পড়ে।  গোটাকয়েক ফেরি আর সাদা রঙের ছোট ছোট বোট ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে জেটির চারপাশে। নেমেই বেশকিছু ছবি তোলা হয়ে গেল। এরপর আমরা এগুলাম দ্বীপের তথ্যকেন্দ্রের দিকে। সেখান থেকে সংগ্রহ করা হলো দ্বীপের ম্যাপ। যে দ্বীপের চারিধারে ৬৩টা ছোট ছোট সুন্দর সৈকত আর ২০টা বে বা উপসাগর, সেখানে ম্যাপের কোন জায়গা থেকে আমাদের এক্সপ্লোরেশন শুরু করবো তাই নিয়েই দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছিলাম আমরা। আমাদের দেখে এগিয়ে এলেন এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা। পরিচয় দিলেন তিনি এই দ্বীপে কাজ করেন ভলান্টিয়ার হিসেবে। সামাজিক দায়িত্বের অংশ হিসাবে বিনা পারিশ্রমিকে সহায়তা করেন দ্বীপ পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষকে। বয়সকালে তার সময়টাও ভালো কাটে মানুষের সঙ্গ পেয়ে। অন্যদি দ্বীপ কতৃপক্ষেরও সুবিধা হয় ভীড় সামলাতে।  উনি জানতে চাইলেন আমরা ভারতীয় কিনা। রুবিনা তখন নিজের পরিচয় দিয়ে আমাদের পরিচিত করিয়ে দিলো। আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি জেনে উনি খুশি হলেন। বললেন, ও তোমরা তো ভালো ক্রিকেট খেলো। কয়েক দিন আগেই তো অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দিলো তোমাদের জাতীয় দল। বিদেশে দেশের প্রশংসা শুনতে কার না ভালো লাগে। মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম আমাদের টিম টাইগারদের।  শ্রেয়’র সাথেও ভদ্রমহিলার আলাপচারিতা জমে উঠলো অনেক। এক পর্যায়ে উনি বলেই ফেললেন, ছেলেটাকে আমার কাছে রেখে যাও। এতোটুকু ছেলের কতো জানার আগ্রহ! এরপর উনি বললেন, রটনেস্টে দেখার আছে অনেক কিছুই। তোমরা সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে যাও। ঘোরার  সহজ উপায় হলো, বাস সার্ভিসের টিকেট করে ফেলা। চক্রাকার এই বাস সার্ভিস সারাদিনই চলে। যেখানে খুশি নামা যায় আর যে কোনো জায়গা থেকেই ওঠা যায়। আমরা ওনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে দ্রুতই বাসের টিকেট করে ফেললাম। বাস সার্ভিস আজ চলবে  বেলা তিনটা পর্যন্ত। এরমধ্যেই আমাদের যতটা সম্ভব ঘোরাঘুরি করে ফেলতে হবে।

রটনেস্টের জেটিতে লুবনা আর রুবিনা

আমরা দ্বীপের পশ্চিম প্রান্ত (ওয়েস্ট এন্ড)থেকে আমাদের অভিযান শুরু করলাম। বাস থেকে নেমে খানিক হেঁটে যাওয়ার পর দেখা মিললো অসাধারণ ল্যান্ডস্কেপের। নীল সাগর আর সুবিশাল আকাশ যেন এখানে এসে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। যেন “আকাশ ছড়ায়ে আছে নীল হয়ে আকাশে আকাশে”। সৈকতে আছড়ে পড়ছে ছোট ছোট ঢেউ। কাঠের পাতাটনে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হয় কি বিশাল এই জগত তার অপার রূপ নিয়ে বসে আছে। আমরা বিশাল এই ইকোসিস্টেমের অতি ক্ষুদ্র একটা অংশ, অথচ মানুষ নিজেদের কতই না ক্ষমতাবান ভাবে। ক্ষমতার দম্ভে এক দেশ আরেক দেশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র কতকিছু নিয়ে মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব। আহা, ক্ষমতাবানেরা যদি প্রকৃতির কাছে, আকাশের কাছে উদার হওয়া শিখতেন!

“যেন আকাশ ছড়ায়ে আছে নীল হয়ে আকাশে আকাশে”

ওয়েস্ট এন্ড থেকে বেরিয়ে আমরা বেশ কয়েকটা স্পটে নেমে পড়েছিলাম। অনেকটা সময় আমরা কাটিয়েছিলাম নীল সমুদ্রের পানিতে পা ভিজিয়ে আর সাদা বালির সৈকতে হেঁটে। আমরা এও বুঝে ফেলেছিলাম যে, পুরো দ্বীপের সব স্পট একদিনে দেখা প্রায় অসম্ভব। ফলে বেশি জায়গায় ছোটাছুটি না করে রটনেস্ট আইল্যান্ডের অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য নিজেদের মতো করে উপভোগ করেছি। আমাদের মধ্যে শ্রেয়ই ছিলো সবচেয়ে অ্যাক্টিভ। সৈকতে সাঁতার কেটে আর পানিতে লাফঝাঁপ দিয়ে ওর সময়টা খুবই উপভোগ করেছে।

সুনীল আকাশ আর নীলাভ সাগর – রটনেস্ট যেন সাগরের মাঝে এক টুকরা স্বর্গ

পুরো রটনেস্ট আইল্যান্ডে প্রকৃতি উপভোগ করার অনেক উপাদান রয়েছে। নিরাপদ স্নরকেলিং করে পানির নীচের জগত উপভোগ করার অনেক স্পট রয়েছে দ্বীপ জুড়েই। যেসব জায়গায় স্নরকেলিং বা ডাইভিং করা বিপদজনক সেসব জায়গায় সাইন দিয়ে মানা করা রয়েছে। ডাইভিং করারও অনেক অপশন রয়েছে। আর সার্ফিংয়ের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত রটনেস্ট। এখানকার বিখ্যাত স্পট হলো “স্ট্রিকল্যান্ড বে”। ১৯৫০ সাল থেকে এখানে স্থানীয় এবং বাইরে থেকে আসা সার্ফাররা নিয়মিত সার্ফিং করেন। কয়েক বছর আগে “রটনেস্ট আইল্যান্ড – স্ট্রিকল্যান্ড বে সার্ফিং পাইওনিয়ার” নামে একটা শর্ট ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানানো হয়েছে এখানকার সার্ফিংয়ের ইতিহাস আর ঐতিহ্য তুলে ধরার জন্য।

সহজ আনন্দের খোঁজে কাটে অলস সময়

আমরা যেহেতু ডাইভার না আর সার্ফিংয়ের মতো সাহসী কাজে পারদর্শীও না আমরা মনোযোগ দিয়েছিলাম দ্বীপের নানা প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য উপভোগ করার। পানিতে নামার পর কাপড় চেঞ্জ করে আমরা পায়ে হেঁটেই এগুতে থাকি বাসের ট্রেইল ধরে। পথে কোথাও দেখা মেলে কোরাল রিফের। লাইমস্টোনের এসব কোরালের বয়স নাকি প্রায় ১ লাখ বছর। সে সময় নাকি সমুদ্রের উচ্চতা এখনকার চেয়ে তিন মিটার বেশি ছিল। লিউইন থেকে আসা উষ্ণ স্রোত নাকি এই কোরাল সিস্টেম গঠনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। তবে সাগরের নিচে ছড়িয়ে থাকা এসব রিফ নিরাপদ জাহাজ চলাচলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এই দ্বীপের আশেপাশে বেশ কয়েকটা জাহাজ ডুবির ঘটনাও ঘটেছিলো অতীতে।     

মনোমুগ্ধকর সৈকতে সারাদিন কাটিয়ে দেয়া যায়

পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার অন্যান্য অনেক জায়গার মতো এই দ্বীপেও অনেক বড় গাছ খুব একটা নেই। আমরা পাহাড়ি উঁচু নিচু পথ ধরে ঝোপঝাড় জাতীয় গাছের সৌন্দর্য্য যতোই উপভোগ করি, রুবিনা আমাদের ততোই সাবধান করে বলে যে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় সাপ এবং সাপের কামড়ে মৃত্যু প্রতিদিনের খবর। সাপের ভয় থাকলেও নির্জন অজানা পথে চারজন পরিচিত মানুষের উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটায় আলাদা একটা রোমাঞ্চ রয়েছে। আমরা সেই রোমাঞ্চ মনে মাখিয়েই এগুতে থাকি। সেই রোমাঞ্চে আরো যোগ হয় এই দ্বীপকে ঘিরে থাকা অস্ট্রেলীয় আদিবাসীদের বিশ্বাস। “হোয়াডজুক নুনগার” নামের আদিবাসীরা প্রথাগতভাবে রটনেস্ট আইল্যান্ডের উত্তরাধিকারী। তাদের ভাষায় এই দ্বীপের নাম “ওয়াডজেমুপ”। এর অর্থ হলো –  জলের ওপারের স্থান যেখানে আত্মারা অবস্থান করে। ৬,০০০-৭,০০০ বছর আগে শেষ বরফ যুগের সময় “ওয়াডজেমুপ” মূল ভূখন্ডের সাথে যুক্ত ছিল। সে সময় আদিবাসীরা পায়ে হেঁটেই সেখানে আসতো এবং নানা ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠান করতো। বৈশ্বিক সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে “ওয়াডজেমুপ” ভূখন্ড থেকে আলাদা হয়ে দ্বীপে পরিণত হয়। এই যে ৭,০০০ হাজার বছর আগের জলবায়ু পরিবর্তনের ঘটনা তার বর্ণনা কিন্তু আদিবাসীদের কথ্য ইতিহাস বা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসা লোককাহিনীতে পাওয়া যায়। রটনেস্টে পাওয়া “আর্টিফ্যাক্ট” কিন্তু আদিবাসীদের দাবীকে সমর্থন করছে যে ৬,৫০০ বছর আগেও “হোয়াডজুক”রা সেখানে  থাকতো। তবে মূল ভূখন্ড থেকে আরাদা হওয়ার পরে সেখানে তাদের থাকার আর প্রমাণ মেলেনি। আদিবাসীদের এখনকার বিশ্বাস হলো মৃত্যুর পর বিদেহী আত্মারা এই দ্বীপে বিশ্রাম নেন। যখন এই পার্থিব জগত থেকে বিদায় নিতে তারা পুরোপুরি প্রস্তুত হন তখন দ্বীপের পশ্চিম প্রান্তে গিয়ে তারা অপেক্ষা করেন। সাগর থেকে আসা তিমি’র পিঠে করে তারা চূড়ান্ত বিশ্রাম নেয়ার জায়গায় চলে যান। আদিবাসীদের কাছে এই দ্বীপ তাই আধ্যাত্মিক স্বর্গ হিসাবে বিবেচিত। সেই স্বর্গে আমরা হাঁটছি। আশেপাশে আর কোনো মানুষজনের দেখা নেই। তাহলে তো বিদেহীদের দেখা মিলতেও পারে, আমাদের রোমাঞ্চে শিহরণ জাগানো এই অনুভূতিও যুক্ত হয়।

রটনেস্ট দ্বীপপুঞ্জের জলজ জীববৈচিত্র্য

অনেকক্ষণ হাঁটার পর আমাদের হুঁশ হয় বেলা দু’টা বেজে গেছে। আমাদের এখন বাস ধরার চেষ্টা করা উচিত। হঠাৎ শ্রেয় প্রশ্ন করলো, আমরা কিন্তু প্রায় এক ঘন্টা ধরে হেঁটেছি। কোনো বাসের তো দেখা মিললো না। এটা বাসের রুট তো? আমরা বাকি তিনজনও তাই ভাবছি। তবে কি পেছনে ফিরে যাবো, নাকি সামনে এগিয়ে যাবো? আবার এক ঘন্টা হেঁটে পেছনে ফেরার অবস্থা আমাদের কারোরই নাই। এক হতে পারে আমরা পথে বসেই বাসের জন্য অপেক্ষা করতে পারি। অথবা এগিয়ে গিয়ে পরের স্টপেজটা খুঁজে বের করতে পারি। একটু জিরিয়ে আমরা সামনে এগুতে থাকি হাঁটার গতি বাড়িয়ে। সাথে চলে জল্পনা-কল্পনা। তবে কি রটনেস্টের  বিদেহী আত্মারাই আমাদের পথ ভুলিয়ে নিয়ে এলো? আমি বলি এখানে আটকা পড়লে মন্দ কি। রাতটা না হয় সুন্দর এই দ্বীপে কাটিয়েই গেলাম। শ্রেয় বাদে অন্যদের অবশ্য তাতে তেমন কোনো আগ্রহ দেখা গেল না। বরং তাদের কপালে চিন্তার রেখা সত্যিই কি আমরা পথ হারালাম! আরো প্রায় আধা ঘন্টা হাঁটার পর দূরে বাসের দেখা মিললো। বাস কাছে আসলে হাত দেখিয়ে আমরা উঠে পড়লাম। আমাদের আর বিদেহী আত্মাদের সাথে রাত কাটানো হলো না! বাসের ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বললেন, আগের বাসের সিডিউল ক্যান্সেল হয়েছে কারিগরী ত্রুটির কারণে। দেরি হওয়ার মূল কারণ সেটিই।

পথ হারিয়ে পথেই বসা

রটনেস্ট আইল্যান্ড যেমন জলবায়ু পরিবর্তনের সাক্ষী, তেমনি অস্ট্রেলিয়ার ঊপনিবেশক শাসনের কালো অধ্যায়েরও সাক্ষী। ব্রিটিশ বসতি স্থাপনকারী দল ১৮২৬ সালে প্রথম পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় আসে। প্রথমে তারা বসতি স্থাপন করে আলবানিতে। এর কয়েক বছর পরেই (১৮২৯) তারা ফ্রিম্যান্টলে সোয়ান রিভার নামে কলোনি স্থাপন করে। এই কলোনি স্থাপনের সময় ভূমির দখল নিয়ে অনেক জায়গাই দ্বন্দ্ব তৈরি হয় “হোয়াডজুক”দের সাথে। আদিবাসীরা তো হাজার বছর ধরে এই জায়গা ভোগ করে আসছে। তারাই তো এই জমির মালিক। যেখানেই জমি নিয়ে সংঘর্ষ বা দ্বন্দ্ব হতো সেখানেই আদিবাসীদের ধরে জেলখানায় ঢোকানো হতো। ১৮৩৮ সালে ব্রিটিশরা আটক এসব আদিবাসীদের ধরে এনে রটনেস্ট আইল্যান্ডে রাখা শুরু করে। তার পরের বছর আনুষ্ঠানিকভাবে রটনেস্টকে কয়েদখানা হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ১৯০৪ সাল পর্যন্ত এটি কয়েদখানা হিসাবেই চালু থাকে। এখানে সে সময় প্রায় ৪,০০০ আদিবাসী পুরুষ এবং কিশোরদের আটকে রাখা হয়েছিলো। এদের অনেককে কয়েকহাজার মাইল দূর থেকে চেইন পরিয়ে আনা হয়েছিলো। এদেরকে শ্রমিক  হিসাবে কাজে বাধ্য করে তৈরি করা হয়েছিলো বড় বড় দালান, মিউজিয়াম, চার্চ, লাইট হাউজ এবং জেটি। এসময় ৩৭০ হাজতি মারা যায় বলে অফিসিয়াল রেকর্ডে উল্লেখ রয়েছে। এদের বেশির ভাগই নানা রোগবালিতে ভুগে মারা গেলেও ৫ জনকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল। ১৯০৪ সালে জেলখানাটা আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করা হলেও জোর করে ধরে এনে শ্রমিক হিসাবে কাজ করানো চলে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত। ১৯০৭ সাল থেকেই ছুটি কাটানোর জায়গা হিসেবে রটনেস্ট আইল্যান্ডকে রূপান্তরিত করার কাজ শুরু হয়। আজকে আমরা যে সুন্দর-পরিপাটি রটনেস্টকে দেখি তা আসলে ঊপনিবেশিক শোষণের ইতিহাসেরও অংশ। আদিবাসীদের কাছে তাই রটনেস্টের বন্দী মিউজিয়াম এবং অনেক স্থাপনা শোষণের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য বহন করে। রটনেস্টের এই ইতিহাস পৃথিবীর  উপনিবেশিক অন্য ইতিহাসগুলো থেকে আলাদা নয়। মানব সভ্যতার ইতিহাসের একটা বড় অংশ জুড়েই আছে নিষ্ঠুরতা আর বর্বরতা। রটনেস্ট আইল্যান্ড নিজেও সেই ইতিহাসের সাক্ষী।

১৯ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের রটনেস্ট আইল্যান্ডে বাইসাইকেল নিয়ে ঘোরাটা অনেক আনন্দের

অস্ট্রেলিয়ার সামরিক ইতিহাসেও রটনেস্ট আইল্যান্ডের নাম জড়িয়ে আছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় রটনেস্টকে সামরিক জেলখানা হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রটনেস্টে স্থাপন করা হয়েছিল ওয়াচ টাওয়ার এবং কামান। ফ্রি ম্যান্টল পোর্টকে সুরক্ষার পরিকল্পনার অংশ ছিল দ্বীপটির সামরিক স্থাপনা। তবে যুদ্ধের সময় এসবের ব্যবহারের কোনো প্রয়োজনই পড়েনি। এসব স্থাপনার অনেক কিছুই এখন সংরক্ষণ করা হয়েছে পর্যটকদের জন্য। সময়ের অভাবে আমরা এগুলো দেখতে পারি নাই বলে আফসোস কিছুটা রয়েই গেছে।

লাইমস্টোন কোরাল আর সাগর মিলে মিশে আছে হাজার বছর ধরে

রটনেস্টে চলার পথে দেখা মেলে কোয়াকা নামের শান্তশিষ্ট এক প্রাণীর। আকারে আমাদের বাসায় পোষা বিড়ালের সমান, কিন্তু দেখতে ইঁদুরের মতো। একে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী প্রাণী। রটনেস্টের নামকরণের সঙ্গে কোয়াকা’র সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। ভোকারসেন নামে এক ডাচ ১৬৯৬ সালে প্রথম ইউরোপীয় হিসাবে কোয়াকার বর্ণনা দেন এইভাবে,“অনেকটা ইঁদুরের মতো, তবে বিড়ালের সমান বড়”। ভোকারসেনই দ্বীপটার নাম দেন “রট নেস্ট” (Rotte Nest), যার অর্থ হলো ইঁদুরের বাসা। পরে “রটনেস্ট” নামেই পরিচিতি পায় এই দ্বীপ। আর কোয়াকা নামটি এসেছে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে বসবাসরত আদিবাসীদের কাছ থেকে। স্তন্যপায়ী কোয়াকা “সেটোনিকস” (Setonix) জেনাসের একমাত্র প্রতিনিধি। ক্যাঙ্গারুর মতো স্ত্রী কোয়াকাও পেটের থলেতে বাচ্চা বড় করে। ২৭ দিনের মতো গর্ভ ধারনের পর সাধারণত গ্রীষ্মের শেষে মা কোয়াকা বাচ্চা প্রসব করে। এরপর দুই মাস বাচ্চা কোয়াকা মায়ের থলেতে বড় হয়। দেড় থেকে দুই বছরের মধ্যেই বাচ্চা পূর্ণ বয়স্ক হয়ে পড়ে। আর এদের গড় আয়ু দশ বছর। কোয়াকা আসলে নিশাচর প্রাণী। দিনের বেশির ভাগ সময়ই এরা ঘুমায় এবং গাছের আড়ালে ছায়ায় বসে ঝিমায়। দিনের বেলায় কখনো কখনো এরা খেতে বের হয়। ঘাস, লতাপাতা, বীজ আর গাছের শেকড় খেয়েই এরা বেঁচে থাকে। গরুর মতো এরাও খাবার গিলে ফেলে। পরে অবসর সময়ে জাবর কাটে। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার আবহাওয়ায় এটাকে ভালো অভ্যাসই বলতে হয়। কারণ এর মাধ্যমেই প্রকৃতিতে বিদ্যমান পুষ্টি আর পানির সবটুকুই কাজে লাগায় এরা। কোয়াকাদের বেঁচে থাকতে অবশ্য খুব অল্প পানির প্রয়োজন হয়। মাসের পর মাস এরা সরাসরি পানি না পান করেও বেঁচে থাকতে পারে। ইউরোপীয়রা যখন প্রথম পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় বসতি স্থাপন করে তখনও রটনেস্ট ছাড়াও বল্ড আইল্যান্ড, এমনকি পার্থের আশেপাশেও কোয়াকাদের দেখা যেত। কিন্তু শেয়ালের মতো প্রাণীর সহজ শিকারে পরিণত হওয়া এবং আবাস স্থল নষ্ট হওয়ার কারণে রটনেস্ট ছাড়া অন্য কোথাও আর এদের দেখা যায় না। রটনেস্টে এখন এদের সংখ্যা প্রায় ১২০০।         

পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী প্রাণী কোয়াকার দেখা মিললো রটনেস্ট আইল্যান্ডে

কোয়াকার দেখা আমরা প্রথম পেয়েছিলাম পশ্চিম-প্রান্তে ঝোপের পাশে অল্প কিছুক্ষণের জন্য। তারপর আবার দেখা পেলাম বাস থেকে নেমে থমসন বে’র পাশে। বেড়াতে আসা মানুষজন কোয়াকার  ছবি তোলার জন্য রীতিমত ভীড় জমিয়েছে। শ্রেয় কোয়াকাকে দেখে ব্যাপক আগ্রহে এগিয়ে গেল। শান্তশিষ্ট প্রাণীটিকে দেখে যে কারুরই ভালো লাগবে। অতিরিক্ত আদর দেখাতে গিয়ে অনেকেই পানি বা খাবার দেয়ার চেষ্টা করে, যেটা করতে একেবারেই না করা হয়। এই আদর কোয়াকাদের মৃত্যুরও কারণ হতে পারে। রটনেস্ট আইল্যান্ড রেঞ্জারদের ক্ষমতা দেয়া আছে কোয়াকাকে খাবার দেয়ার অপরাধে যে কাউকে আটক করার। শ্রেয়কেও আমাদের সে কথা মনে করিয়ে দিতে হয়েছিল। এরই ফাঁকে আমরাও কোয়াকার বেশকিছু ছবি তুলে ফেললাম।

কাঠের পাটাতনে দাঁড়িয়ে ভারত মহাসাগর দেখা – শ্রেয়, রুবিনা আর লুবনা

ভূখন্ডে বসবাসরত কোয়াকা ছাড়াও রটনেস্টের জীববৈচিত্র্য অনেক সমৃদ্ধ। প্রায় ৪০০ প্রজাতির মাছ আর ২০ প্রজাতির কোরালে সমৃদ্ধ এই দ্বীপ। এই দ্বীপের আশেপাশেই বছরের বিশেষ বিশেষ সময়ে দেখা মেলে কুঁজো তিমি, বটলনোজ ডলফিন, নিউজিল্যান্ড ফার সিল এবং অস্ট্রেলিয়ান সি লায়নদের। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় কুঁজো তিমিদের মোট সংখ্যা ২০০০ থেকে ৩০০০ এর মধ্যে। আর পূর্ব  অস্ট্রেলিয়ায় এই সংখ্যা ১২০০ এর মতো। গ্রীষ্মের সময় এরা অ্যান্টার্কটিকায় থাকে আর শীতের সময় চলে আসে উত্তর গোলার্ধে। মাইগ্রেটরি হলেও এরা সবাই রটনেস্ট ইকোসিস্টেমেরই অংশ। একেকটা পূর্ণ বয়স্ক কুঁজো তিমির ওজন প্রায় চল্লিশ টন আর দৈর্ঘে প্রায় ১৯ মিটার। ১৯৬৩ সালের পর থেকে তিমি শিকার পুরোপুরি নিষিদ্ধ। কারণ তিমি বাঁচলে পরিবেশ বাঁচবে। রটনেস্টের পশ্চিম প্রান্তে একটি তিমি দেখার স্টেশন আছে। কুঁজো তিমির সাঁতরে চলা খুব কাছে থেকে উপভোগ করা যায় এখান থেকে। আমরা অবশ্য তিমি দেখার সুযোগ পাইনি। মনে হচ্ছে তিমি রাত অন্যান্য জীববৈচিত্র্য ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতেই আবার রটনেস্টে যেতে হবে।

আমরা রটনেস্টের প্রকৃতির মাঝে

কোয়াকাদের সাথে সময় কাটাবার পর ক্ষুধার্ত আমরা ছুটলাম পেটপুজা করতে। বাস স্টপের পাশের ফুডকোর্টে সব ধরনের খাবার পাওয়া যায়, এমনকি ভারতীয় খাবারও মেলে। শ্রেয়’র উত্সাহে সেখানে আমরা অর্ডার করলাম সহজ খাবার বার্গার। খাবার শেষ করে যখন আমরা বেরিয়েছি, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকালের আলো খেলা করছে সুনীল সাগরে। দুর্দান্ত এক সূর্যাস্তের সম্ভাবনা তখন আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। কিন্তু আমাদের ফিরতে হবে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাদের উঠতে হলো ফিরতি ফেরিতে। তবে সাথে নিয়ে এলাম নীল সাগরের বুকে জেগে থাকা রটনেস্ট আইল্যান্ডে কাটানো দুর্দান্ত একটা দিনের স্মৃতি নিয়ে। যে সহজ আনন্দের খোঁজে আমরা এসেছিলাম রটনেস্ট সেই আনন্দের ঝাঁপি খুলে ধরেছিলো আমাদের জন্য।   আমরা জেনেছি জলবায়ু পরিবর্তনের ইতিহাস। যে ইতিহাসে “হোয়াডজুক” নামের আদিবাসীদের গল্প রয়েছে। আবার আমরা জেনেছি ঊপনিবেশক শোষণ, নিপীড়ন ও বঞ্চনার কদর্য স্মৃতি। রটনেস্ট আমাদের মনে করিয়ে দেয় জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আমাদের দায়িত্বের কথা, মনে করিয়ে দেয় ইতিহাসের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নেয়ার কথা। অধিকার পাক “হোয়াডজুক”রা। বেঁচে থাকুক “ওয়াডজেমুপ”, বেঁচে থাকুক কোয়াকারা, বেঁচে থাকুক কুঁজো তিমি, সিল, ডলফিন আর কোরালেরা।

সাগর আর আকাশ মিলে মিশে একাকার

আনোয়ারুল হক।

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments