২০১৮ সালে প্রথম যে বার পার্থে গেলাম, আমাদের এক অস্ট্রেলীয় কলিগ বলেছিলেন, পার্থে যাচ্ছো, দেখবে সমুদ্রের কী রূপ। আমরা সমুদ্র দেখতে পার্থেই বেড়াতে যাই। সে বার আমরা পার্থের আশেপাশেই ঘুরেছি, আর মুগ্ধ হয়ে দেখেছি নীল সমুদ্র। সে সময় লুবনার ছোট বোনের বর আমাদের ছোট ভাই শাহেদ বলেছিল, চলেন আলবানি যাই। আসল সমুদ্রের রূপ দেখতে পাবেন সেখানেই। আমরা যারা পার্থে থাকি, তারা ছুটি কাটাতে ছুটি আলবানির দিকে। সে বার আর আলবানি যাওয়া হয়নি। কিন্তু ঐ বছরই ডিসেম্বর মাসে আমরা আবার যখন পার্থে যাই, তখন আর আলবানি মিস করতে চাই নি। আমরা দ্রুতই প্ন্যান করে ফেলি আলবানি যাবো দুই রাতের জন্য। যারা নিয়মিত ভ্রমণ করেন তারা জানেন ডিসেম্বরের শেষে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তেই রাতে থাকার জায়গা খুঁজে পাওয়াটা কষ্টের। পেলেও বাড়তি খরচ গুনতে হয় এবং তারপর টুরিস্ট স্পটে গিয়ে মানুষের ভীড়ে হারিয়ে যেতে হয়। আমরা বাংলাদেশীরা অবশ্য ভীড়ে অভ্যস্ত। ভীড় না থাকলেই বরং কখনো কখনো আমরা অস্বস্তিবোধ করি! কিন্তু যত ঘটনাই ঘটুক, এবার তো আলবানি মিস করা যাবে না। বুকিং ডটকমে অনেক খোঁজাখুঁজির পর একটা মোটেলে দুটা ফ্যামিলি রুম পেয়ে গেলাম। শাহেদ, শাহেদ ও রুবিনার ছেলে ইশান, শ্রেয়, লুবনা আর আমি মিলে ছোট একটা টিম তৈরি হয়ে গেল। লুবনার ছোট বোন রুবিনা এবং ছোট ভাই সবুজের বৌ বাচ্চাসহ যাওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত ওরা যেতে পারে নি। রুবিনার লাল টুকটুকে হুন্ডাই টুসান গাড়িটি নিয়ে আমরা ২২ তারিখ সকালে বেরিয়ে পড়লাম আলবানির পথে দক্ষিণ মহাসাগরের রূপ দেখবো বলে।
রকিংহ্যাম সিটি থেকে আলবানির দূরত্ব ৪শ কিলোমিটারের মতো। মানে ঢাকা-দিনাজপুর দূরত্বের সমান। যেতে সাড়ে চার ঘন্টার মতো লাগে। আগেও আরেকটা লেখায় বলেছিলাম পশ্চিম অস্ট্রেলীয়ায় গাড়ি চালানোটা অনেক আনন্দের। প্রকৃতির মাঝে মসৃণ রাস্তা। রাস্তায় গাড়ি ছোটাছুটি করছে নিয়ম মেনে ঠিকই, কিন্তু পথঘাট জনমানবহীন। কোনো কোনো রাস্তায় টানা কয়েক ঘন্টা চললেও মানুষের দেখা মেলা দায়। আমাদের দেশের অভিজ্ঞতার পুরো বিপরীত। এই অভিজ্ঞতা ভালো লাগলেও মনে প্রশ্ন জাগে, পৃথিবীর কোথাও কোথাও জনবসতি প্রায় নেই, আবার কোথাও কোথাও মানুষ রয়েছে ঠেসে। এরকম একটা পৃথিবী কি ন্যায্য বা টেকসই? টেকসই যে না তা আমরা এই প্যান্ডেমিকের সময়টায় তো ভালোভাবেই বুঝলাম। অন্যায্য পৃথিবীতে আর যাই হোক করোনা মহামারির মতো দুর্যোগ মোকাবিলা করা অনেক কঠিন হবে।
মিউজিক প্লেয়ারে চললো মৌসুমী ভৌমিকের গান, “স্বপ্ন দেখবো বলে আমি দু’চোখ মেলেছি”। সমুদ্র দেখতে যে আয়োজন তাতে এই গান না থাকলে চলে! আমরা চললাম হাইওয়ে ধরে। দু’ধারে বিস্তৃত কৃষিক্ষেত। বেশির ভাগ ক্ষেতেই সবেমাত্র গম কাটা হয়েছে। গমের খড়গুলো রোল করে মাঠের মধ্যে রাখা। দূর থেকে এদের মনে হয় রোলার। শাহেদ পেশায় প্রকৌশলী। কাজ করে পার্থের পানি উন্নয়নের বোর্ডে। ও বলছিল যে পুরো পশ্চিম অস্ট্রেলীয়া আসলে মরুভূমির অংশ। ফলে পানি সরবরাহ সব সময়ই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। একরের পর একর জমি পানির দরে (বাংলাদেশের পানির দর!) লিজ পাওয়া যায়, কিন্তু সেই জমিতে পানির যোগান দেয়া কঠিন এবং ব্যয়সাপেক্ষ। এমন অনেক এলাকা আছে যেখানে পাইপযোগে পানি আনা হয় পাঁচছয়শ কিলোমিটার দূরের কোনো নদী থেকে। ভালো ব্যাপার হলো, অস্ট্রেলীয়রা যখন নতুন কোনো শহর বা বসতির পরিকল্পনা করে তখন সেই পরিকল্পনায় একশ বছর পরের চাহিদা বিবেচনায় রাখা হয়। ফলে যোগাযোগ, আবাসন, পানি ব্যবস্থাপনা, পয়ো:নিষ্কাশন, কৃষিকাজ – সব মৌলিক বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখা হয়। এসব শুনলে মন খারাপ লাগে এই ভেবে আমরা কেন পারি না। আমাদের দেশে এখন শহর গড়ে ওঠে হাইওয়েকে ঘিরে কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই। অপরিকল্পিত নগরায়ন কি কি সমস্যা তৈরি করতে পারে তার দারুণ এক পাঠশালা হতে পারে আমাদের এই দেশ।
শাহেদ আর আমি দুজন ভাগাভাগি করে গাড়ি চালিয়ে মোটামুটি পাঁচ ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম আলবানিতে। ছোট্ট শহর। এক সময় আলবানির ছিল এঅঞ্চলের মূল পোর্ট। ফ্রিম্যান্টেল পোর্ট হিসাবে চালু হওয়ার পর আলবানি বন্দর হিসাবে তার গুরুত্ব হারায়। শহরে মানুষজনের ভীড় তো খুব একটা চোখে পড়ে না। ট্যুরিস্ট শহর, হোটেলে জায়গা নেই, কিন্তু কোথাও তো জ্যাম নেই। নেই ভীড়ভাট্টা। মনে হয় আমার মাথায় কক্সবাজারের ভীড়ের দৃশ্য গেঁথে ছিল! যেহেতু আমাদের পরিকল্পনা ছিল দুপুর আর বিকালটা কাজে লাগানোর, রাস্তায় চেইনশপ কোলসের একটা শাখা থেকে বার্গারজাতীয় কিছু খাবার কিনে আমরা মোটেলে চেকইন করলাম। এরপর দ্রুত লাঞ্চ সেরেই বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য আলবানি উইন্ড ফার্ম।
আলবানি উইন্ড ফার্ম – সবুজ প্রকৃতিতে সবুজ প্রযুক্তি
আলবানিতে আমরা এলাম সমুদ্র দেখবো বলে, অথচ প্রথমেই গেলাম উইন্ড ফার্মে।উইন্ডমিল অবশ্যই দেখার মতো বিষয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তো মানুষের বানানো একটা যন্ত্রই। লুবনা আর আমি দুজনই যে খুব একটা উৎসাহী ছিলাম তা না। আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথ ঠেলে যখন উইন্ড ফার্মে পৌঁছালাম আমাদের ভুল ধারণাটা ধীরে ধীরে ভাঙ্গতে লাগলো। গাড়ি থেকে নেমেই মনে হলো আমরা পুরো সবুজের মাঝে অবস্থান করছি। সামনে তাকিয়ে দেখি সারি সারি উইন্ডমিল সবুজ পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে ডানা মেলে দাঁড়িয়ে। সেই ডানাগুলো বেশ অলস ভঙ্গিতে নড়ছে। ভাবখানা এমন যে তাদের সময় আর কাটে না। ঘুরতে পারাটাই যেন তাদের সার্থকতা। উইন্ডমিল দেখলেই আমার সারভান্তেসের কমিক হিরো ডন কুইক্সোটের কথা মনে পড়ে। ডন কুইক্সোট বিশ্বজয়ের অভিযানে বের হয়ে উইন্ডমিলকে দৈত্য কল্পনা করে নিজের ঢাল তলোয়ার নিয়ে যারপরনাই যুদ্ধ করতে থাকে। আমরা নিজেরাও কি জীবনের কোনো কোন সময় ডন কুইক্সোটের ভূমিকায় অবতীর্ণ হই না? বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে যুদ্ধ করতে থাকি বানানো শত্রুর বিরুদ্ধে। আমার এসব আবোলতাবোল ভাবনার তাল কেটে গেল মাছির কামড় খেয়ে। আমরা মশার কামড় খেয়ে অভ্যস্ত। আর আলবানির মাছি মানুষের শরীরের খোলা জায়গা কামড়ে ধরতে পটু। মহা যন্ত্রণায় পড়া গেল। সারাক্ষণ হাত-পা নাড়াতে হচ্ছিল মাছি তাড়ানোর জন্যে।
উইন্ড ফার্মের কিছু তথ্য চমকপ্রদ। বিদ্যুৎ উৎপাদনে সবুজ প্রযুক্তির ব্যবহারের কথা চিন্তা করে ২০০১ সালে বায়ুচালিত ১২টা বিশাল সাইজের টারবাইন দিয়ে যাত্রা শুরু করে এই উইন্ড ফার্ম। এরপর ২০১১ সালে যুক্ত হয় আরো ৬টা টারবাইন। প্রতিটি উইন্ডমিলের ডানা তিনটা, যার একেকটার দৈর্ঘ্য ৩৫ মিটার। এগুলো স্থাপিত হয়েছে ৬৫ মিটার উচ্চতার টাওয়ারের ওপর। স্থাপন করার সময় এগুলোই ছিল দক্ষিণ গোলার্ধের সবচেয়ে বড় আকারের টারবাইন যন্ত্র।স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে চলা এই উইন্ডমিলগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন আলবানির শক্তিশালী ঝড় বা বৈরি আবহাওয়া এরা সামলাতে পারে। এগুলো স্থাপিত হয়েছে ১২ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪০ মিটার উচ্চতায় এগুলোকে এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছে যাতে আলবানির বায়ুপ্রবাহের পুরোটা কাজে লাগানো যায়। এখন ১৮টি উইন্ডমিল থেকে সর্বোচ্চ ৩৫.৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় এই উইন্ডফার্মে, যা আলবানির মোট বিদ্যুৎ চাহিদার ৮০ শতাংশ পূরণ করে। সারা বিশ্বের জন্য এটা দারুণ খবর। বিদ্যুৎ উৎপাদনে উইন্ডমিল যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে আলবানি তা হাতে-কলমে করে দেখিয়েছে। আশা করি, ফসিল এনার্জির পরিবর্তে বাতাসকে কাজে লাগাতে আরো নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করবে এই ফার্ম। ধরিত্রী বাঁচাতে এখন গোটা বিশ্বকেই এপথ ধরতে হবে। নীল সমুদ্রের পাশে সবুজের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা উইন্ডমিলগুলোকে তখন আর ডন কুইক্সোটের দৈত্য মনে হচ্ছিলো না, বরং এগুলোকে মনে হচ্ছিলো ধরিত্রির নতুন আশার প্রতীক।
আমরা সবাই উইন্ডমিল নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত ছিলাম যে এর উল্টাদিকে প্রকৃতি যে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল তা টেরই পাইনি। পার্কিংয়ের পাশের ট্রেলার ধরে খানিকটা আগানো পরই চোখে পড়লো বিশাল নীল সমুদ্র। সেই সমুদ্র আবার ধাক্কা খাচ্ছে সবুজ পাহাড়ের সাথে। পাহাড়ের ওপর থেকে কাঠের সিঁড়ি নেমে গেছে সমুদ্র সৈকত পর্যন্ত। মাঝে মাঝে চৌকোনো জায়গা রাখা হয়েছে নয়নাভিরাম দৃশ্য উপভোগ করার জন্য। সঙ্গে সমুদ্রের দমকা বাতাস। বোঝা গেল কেন উইন্ডমিলগুলো এই জায়গাতেই স্থাপন করা হয়েছে। আমরা পরম বিস্ময়ে ভারত মহাসাগরের রূপ দেখতে লাগলাম। এরপর দীর্ঘ সিঁড়ি ভেঙ্গে আমরা নেমে গেলাম সমুদ্র সৈকতে। বেশ বড় সৈকত আর সেখানে আমরা ছাড়া আর তেমন আর কেউ নেই। একদিকে নীল সমুদ্র আর একদিকে সবুজ পাহাড়। সমুদ্রের বিশাল বিশাল ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে পাহাড়ের গোড়ায়। পানির কণা ঝিরঝিরিয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে চারদিকে। আমরা কিছুক্ষণ প্রাণভরে নি:শ্বাস নিলাম। শ্রেয় আর ইশান ছোটাছুটি করলো সৈকত ধরে। যখন ফেরার পথ ধরলাম, তখন বুঝলাম কি কঠিন চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। সিঁড়ি ভেঙ্গে নামার সময় তো খেয়াল করি নাই কত নীচে নেমেছি। ওঠার সময় প্রিয় ক্যামেরার ব্যাগকেই মনে হচ্ছিলো পাথর বোঝাই বস্তা। পনেরো-বিশ স্টেপ উঠে দাঁড়িয়ে যাই, দম নেই, তারপর আবার উঠি। আমাদের মধ্যে ইশান আর শ্রেয়ই দ্রুত উঠে গেল। আমরা যখন পার্কিংয়ে পৌঁছালাম তখন মনে হলো যাক বাবা এবারের মতো বাঁচলাম। গাড়িতে থাকা পানির বোতলগুলো শেষ করে আগে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিলাম। এরপর রওনা দিলাম টোর্নডিরাপ ন্যাশনাল পার্কের পথে।
দ্য গ্যাপ এবং ন্যাচারাল ব্রীজ – প্রকৃতির বিস্ময়
২০ মিনিটের ড্রাইভেই আমরা পৌঁছে গেলাম টোর্নডিরাপ ন্যাশনাল পার্কে। সবুজে ঘেরা সৈকত থেকে আমরা ঢুকলাম শক্ত পাথুরে এক রাজ্যে। পার্কের এ অংশ ক্যাসল রক নামেও পরিচিত। পাথরগুলো আসলে গ্রানাইট। আমরা সমুদ্র থেকে প্রায় ৪০ মিটার উঁচুতে। আর সামনে দিগন্ত বিস্তৃত নীল দক্ষিণ মহাসাগর। প্রচন্ড বেগে সাগরের ঢেউ আছড়ে পড়ছে পাথুরে দেয়ালে। যেন সবকিছু ভেঙ্গে ফেলবে। আর গ্রানাইটের শক্ত পাথর যেন হেসে উত্তর দিচ্ছে আমাকে ভাঙ্গা এতো সহজ নয়। সাগর তখন রেগে বলছে, দেখিস, একদিন ঠিকই ভেঙ্গে ফেলবো। আলবানির পুরো উপকূল জুড়েই তো পাহাড় আর ছোট ছোট সৈকত। কিন্তু হঠাৎ করে এখানে গ্রানাইটের পাহাড় কোত্থেকে এলো সেও এক প্রকৃতির বিস্ময়। তিন ধরনের মৌলিক পাথরের সংমিশ্রনে নাকি এই বিশেষ গ্রানাইট গঠিত। বিজ্ঞানীরা বলছেন এই গ্রানাইটের বয়স অন্তত: ১২শ মিলিয়ন বছর। ঐ সময় অস্ট্রেলীয় প্লেটের সাথে অ্যান্টার্কটিকা প্লেটের ধাক্কা লাগে। আর তখনই সমুদ্র ফুঁড়ে এই পাথুরে পাহাড় গঠিত হয়। সমুদ্র আর পাহাড়ের এ গল্প তো পৃথিবী নামের আমাদের এ গ্রহের বিবর্তনের গল্পই।
আমরা এবড়োথেবড়ো পাথরের ওপর স্টীলের পাত দিয়ে তৈরি পথ ধরে সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা ‘দ্য গাপ’এ পৌঁছালাম। পাহাড়ের মাঝে একটা বড় ফাঁকা স্থান। পাহাড় যেন হঠাৎ দুভাগ হয়ে গেছে। সেখানে যেন সাগরকে ভেতরে ঢোকার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। স্টীলের তৈরী পাতাটনটা পাহাড়ের শেষ মাথা ছাড়িয়েও প্রায় ১০ মিটার বর্ধিত। কোনায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালে মনে হয় শূণ্যে ভাসছি। সাগরের দমকা হাওয়া আমাদের যেন সত্যিই ভাসাতে চাইছে। আর নীচ থেকে আসছে পাথরের বুকে সাগরের আছড়ে পড়ার শব্দ। শরীর স্পর্শ করে যাচ্ছে ভেসে আসা পানির কনা। নীচে তাকালে চোখে পড়ে ফেনায় ভরা গভীর খাদ। কোনোভাবে পড়লে আর রক্ষা নাই। লাশ উদ্ধার করতে হেলিকপ্টার নিয়ে আসতে হয় উদ্ধারকারীদের। সাবধানতা অনেক, কিন্তু তারপরও দুর্ঘটনা ঘটে। ট্যুরিস্টদের খামখেয়ালীপনাই সে সব দুর্ঘটনার কারণ। আমাদের সাথে এদিন দেখা হলো বিয়ে করতে যাচ্ছেন এমন এক যুগলের সাথে। তারা এসেছেন ওয়েডিং ফটোগ্রাফি করতে। বিশেষ মুহূর্ত ধরে রাখতে তো এমন জায়গাতেই আসতে হয়। পরে জেনেছিলাম শুধু বিয়ের জন্য নয়, কেউ কেউ ‘আত্মহত্যা’ করতেও বেছে নেয় এই জায়গা। পৃথিবীটা বোধহয় এরকমই – সৌন্দর্য কখনো ভয়ঙ্কর হয়, আর জীবন-মৃত্যু থাকে পাশাপাশিই। ‘দ্য গ্যাপ’এ দাঁড়িয়ে আমরা দেখলাম দক্ষিণ মহাসাগরের অপূর্ব সুন্দর রূপ। পুরো পার্কের পাথুরে সৌন্দর্যও আমাদের বিমোহিত করলো।
এরপর আমরা গেলাম ‘ন্যাচারাল ব্রীজ’ বা প্রাকৃতিক সেতুর কাছে। সেও আরেক প্রাকৃতিক বিস্ময়। পাথুরে পাহাড়ের নীচে বেশ কিছুটা ফাঁকা জায়গা। সেই চ্যানেল দিয়ে সাগরের পানি ঢুকছে। উপরে পাথরেরই সেতু। দেখে মনে হয় দুই অংশকে যুক্ত করতেই সেতুটির স্থাপন করা হয়েছে। আসলে প্রকৃতির লীলাখেলা বোঝা বড় দায়। ‘ন্যাচারাল ব্রীজের এই জায়গাটা ‘দ্য গ্যাপ’এর তুলনায় ফ্ল্যাট। তবে এখান থেকেও সমুদ্র উপভোগ করা যায়। আরো খানিকটা সময় কাটিয়ে আমরা রওনা দিলাম পরবর্তী গন্তব্যে। যাওয়ার সময় মনে হলো, আরে এখানে সূর্যাস্ত উপভোগ করাটা তো হতো বিশেষ অভিজ্ঞতা। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম পরের দিন সূর্যাস্ত দেখতেই এখানে আবার আসবো এবং পরের দিন ঠিকই ফেরত এসেছিলাম। ১২শ মিলিয়ন বছর বয়সী গ্রানাইট ওপর বসে দক্ষিণ মহাসাগরের বুকে সূর্য ডোবা দেখাটা ছিল দারুণ এক অভিজ্ঞতা। ক্ষণে ক্ষণে রঙের বদল, সাথে দমকা হাওয়া আর সাগরের ডাক – সব যেন মনে করিয়ে দিলো বিপুলা ধরণীর খুব ক্ষুদ্র অংশ আমরা, কিন্তু আমাদের জন্যই প্রকৃতির কত রূপ ছড়ানো আর কত রকমের উপস্থাপনা!
টোর্নডিরাপ ন্যাশনাল পার্ক থেকে বেরিয়ে আমরা ছুটলাম আলবানির ঐতিহাসিক হোয়েলিং স্টেশনের দিকে। সাগর থেকে তিমি শিকার করে তা প্রসেসিং করা হতো এখানে। এখানকার শেষ চালু কোম্পানীর নাম ‘চেয়নেস বীচ হোয়োলিং’। ১৯৭৮ সালে কোম্পানীটি বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৮০ সালে এটিকে একটি যাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়। এখনকার প্রজন্ম এই যাদুঘরে জানতে পারে তিমি সংক্রান্ত নানা তথ্য। তারা আরো সচেতন হয় তিমি আর প্রকৃতি সংরক্ষণের ব্যাপারে। আমরা যখন ওখানে পৌঁছালাম তখন সূর্য ডুবি-ডুবি করছে। যাদুঘর বন্ধ। একটা কফির দোকান খোলা। আমরা কফি হাতে পুরো এলাকার শান্ত নিরবতা উপভোগ করতে লাগলাম। আমাদের অবাক করে দিয়ে একটু পর চাঁদ উঠলো, তাও পূর্ণিমার চাঁদ। নিস্তব্ধ বেলাভূমিতে বসে কফির মগ হাতে আমরা কাটাতে থাকলাম দারুণ এক সন্ধ্যা। এরকম সন্ধ্যা জীবনে খুব কমই আসে যেখানে প্রকৃতি এসে কানে কানে বলে, জীবন আসলেই অনেক সুন্দর। তাই অবহেলা না করে জীবনটাকেই উপভোগ করো।
আলবানির নীলাকাশ আর অপরূপ সৈকত
দ্বিতীয় দিন আমাদের প্ল্যান ছিল আলবানির বিখ্যাত সব সৈকত ঘুরে দেখা। আমরা শুরু করলাম ‘টু পিপলস বে’ দিয়ে। শাহেদ ঝোপঝাড়ে ঘেরা একটা জায়গায় গাড়ি পার্ক করে আমাদের হাঁটা সবুজ পথ ধরে সৈকতে নিয়ে গেল। পারিবারিক সময় কাটানোর জন্য সৈকতটা আদর্শ। সাগর এখানে শান্ত। স্বচ্ছ নীল পানি আর বিস্তীর্ণ আকাশ জায়গাটাকে করে তুলেছে ভীষণ সুন্দর। কয়েকটা পরিবারকে দেখলাম পিকনিক ম্যুডে সারাদিন কাটানোর আয়োজন করছে। কেউ কেউ সঙ্গে স্পীড বোটও এনেছে। ইশান আর শ্রেয় যথারীতি হাঁটুজলে নেমে আনন্দ করতে থাকলো। একটু সামনে এগুতেই চোখে পড়লো একাকী একটা ফ্লেমিঙ্গো পাখি পানিতে সাঁতার কাটছে। পাখিটা অনেক কাছাকাছি চলে এলো। মনে হলো তারও সঙ্গ দরকার। ক্যামেরায় ধরে ফেললাম পাখিটাকে। সৈকতটা সুন্দর হলেও মরা আগাছার কারণে কোনো কোনো জায়গায় পানি কিছুটা কালো হয়ে আছে। নীলের মাঝে এই রঙ যেন বেমানান।
ওখান থেকে বেরিয়েই আমরা গেলাম কাছাকাছি আরেকটা সৈকতে, যার নাম ‘লিটল বীচ’। বীচে যেতে এবারো আমাদের কাঠের সিঁড়ি ভাঙ্গতে হলো। তবে এবারে সিঁড়ির সংখ্যা কম। মিনিট পাঁচেকের পথ পেরিয়েই আমরা পৌঁছে গেলাম বীচে। নামকরণই বলে দেয় বীচটা ছোট। ছোট হলে কি হবে, এখন পর্যন্ত আমাদের দেখা সবচেয়ে সুন্দর বীচের একটি হলো এই ‘লিটল বীচ’। সাদা বালি, নীল সাগর আর সাথে বড় বড় পাথর। সৈকতের ব্যাকগ্রাউন্ডে সবুজ পাহাড়। সব মিলিয়ে অনাবিল এক পরিবেশ। স্বচ্ছ পানিতে পা ভিজিয়ে, সৈকতে হাঁটাহাঁটি করে আর পাথরে শুয়ে আকাশ দেখে আমরা সময় কাটালাম মহাআনন্দে।
‘লিটল বীচ’ থেকে বেরিয়ে আমরা গাড়িতে করে রওনা দিলাম ‘উইলিয়াম বে ন্যাশনাল পার্ক’-এর পথে। ৪,২৮০ একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই পার্কের ভেতরেই আছে ‘গ্রীনস পুল’ আর ‘এলিফ্যান্ট রকস’। দুটি জায়গাই সাঁতারের জন্য নিরাপদ। আর সেকারণে দলে দলে মানুষ পরিবারসমেত এই পার্কে আসে। এখানে এসে প্রথমবারের মতো মনে হলো আলবানি একটা ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন, যেখানে মানুষজন ভীড় করে। তবে সে ভীড় আমাদের কক্সবাজার বীচের ভীড়ের ধারেকাছেও না। এখানে এসে মুগ্ধ হলাম পাথর, সমুদ্র আর আকাশের অদ্ভুত সুন্দর কম্পোজিশন দেখে। চারদিকে ছোটবড় পাথরগুলো এমনভাবে ছড়িয়ে আছে যেন কেউ এগুলোকে সযত্নে রেখেছে দক্ষিণ মহাসাগরের প্রলয় থেকে ‘উইলিয়াম বে ন্যাশনাল পার্ক’কে রক্ষার জন্যই। আমরা এক পাথর থেকে লাফিয়ে অন্য পাথরে গেলাম। পাথরে বসেই পানিতে পা ভেজালাম। শ্রেয় আর ইশান পানিতে নেমে সাঁতার কাটলো। ‘এলিফ্যান্টস বে’র সৌন্দর্যটা সাদাবালির বীচ থেকে আলাদা। এরপাশেই ‘গ্রীন পুলস’ মূলত সাঁতার কাটার জায়গা। অনেক মানুষ বাচ্চাকাচ্চাসহ নেমে পড়েছে পানিতে। এখানে সবচেয়ে ভালো লাগলো আমাদের শরতের আকাশের মতো ছড়ানো মেঘদল আর নীল সাগরের মিলন। আর সাথে ছড়ানো ছিটানো গোলগোল পাথরের কম্বিনেশন পুরো ল্যান্ডস্কেপটাকেই দিয়েছে অন্য এক মাত্রা। ক্যামেরায় সেই সৌন্দর্য ধরে রাখার চেষ্টা করলাম কিছুক্ষণ।
‘এলিফ্যান্টস রকস’ থেকে বেরিয়ে ‘উইলিয়ামস বে পার্ক’-এর ভেতর দিয়ে আমরা ফিরলাম পার্কিং স্পটে। ফেরার পথটাও ছিল দারুণ উপভোগ্য। পথের পাশেই ফুটে আছে নাম না জানা ফুল। ভেসে আসছে স্থানীয় পাখির গান। চারপাশে জঙ্গল আর পাথুরে পাহাড়।
সব মিলিয়ে সমুদ্র দেখার দারুণ এক অভিজ্ঞতা হলো আলবানিতে। আমরা শাহেদের সাথে একমত হলাম যে আলবানির সমুদ্র আর সৈকতগুলো যেন রূপের পসরা সাজিয়ে বসে আছে। বিশ্বের একেক জায়গার সমুদ্রের রূপ একেক রকম। এক জায়গার সাথে আরেক জায়গার তুলনা করার কোনো মানে হয় না। তবে দুইদিনে আমরা আলবানির সমুদ্র আর প্রকৃতির যে রূপ দেখেছি তা সত্যিই অনন্য। শাহেদের সাথে সূর মিলিয়ে আমিও এখন বলি সমুদ্রের আসল সৌন্দর্য দেখতে হলে যাও আলবানিতে।
লেখাটি ‘দেশকাল পত্রিকা’র অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।