২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে গিয়েছিলাম নাপোলিতে ঘোরাঘুরি দুটি প্রধান জায়গা মাথায় রেখে। দেখতে চাই বিস্মৃতপ্রায় পম্পেই নগরী আর উঠতে চাই ভেসুভিয়াসের শিখরে। মনে পড়ে প্রথম ভেসুভিয়াসের নাম জানতে পাই স্কুলের ভূগোল বইয়ের আগ্নেয়গিরি নিয়ে লেখা চ্যাপ্টারে। স্কুল জীবনে মুখস্ত করেছিলাম ইতালির ভেসুভিয়াস আর জাপানের ফুজিয়ামার নাম। তারপর বিটিভির ‘মুভি অফ দ্যা উইক’ এ ‘দ্য লাস্ট ডেজ অফ পম্পেই’ সিনেমায় দেখেছিলাম ভেসুভিয়াসের ধ্বংসযজ্ঞ।
আমরা ছিলাম সুইজারল্যান্ডের লুজার্ন শহরে। সেখান থেকে নাপোলি যাব। দেশ থেকে নাপোলির হোটেল বুক করে এসেছি। ইচ্ছা ছিল ট্রেনে যাব। আগেরবার বার্ন থেকে রোমে গিয়েছিলাম ট্রেনে। ভ্রমণটা পছন্দ হয়েছিল। ট্রেনে গেলে দেশগুলোর ল্যান্ডস্কেপ সম্পর্কে একটা ভালো ধারণা তৈরি হয়। এবার দেখলাম ট্রেনে সময় বেশি লাগছে। আবার ভাড়াটাও প্লেন আর ট্রেনের প্রায় সমান। অনলাইনে বাজেট এয়ারলাইনের টিকেট করলাম। চেক ইন করতেই প্রথম বিপত্তি। হ্যান্ড লাগেজ কোনোভাবেই একটার বেশি নেয়া যাবে না। আমার সঙ্গে একটা ল্যাপপট ব্যাগ আরেকটা ক্যামেরার। অগ্যতা লাইন থেকে বেরিয়ে ক্যামেরার ব্যাগে ল্যাপটপ ঢুকিয়ে ফেললাম। তারপর ল্যাপটপ ব্যাগটা চ্যাপ্টা করে ঢুকালাম মূল ব্যাগে। এরপর হাসিমুখে আবার লাইনে দাঁড়ালাম। অতিরিক্ত টাকা দিয়ে ক্যামেরার ব্যাগ নিতে হলো না, আমি এতেই খুশি। একবার যুক্তরাষ্ট্রে এরকম এক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। আমি যাব আটলান্টায়। ফ্লাইট আমাকে নামিয়ে দিল শিকাগোতে। এবার সেখান থেকে আরেকটি এয়ারলাইনের কানেক্টিং ফ্লাইটে যাব আটলান্টা। সেই ফ্লাইটে বিশ কেজির বেশি লাগেজ নিতে গেলে অতিরিক্ত টাকা দিতে হবে। প্রায় একশ ডলার অতিরিক্ত পে করে আমি সেবার ফ্লাইটে উঠেছিলাম।
প্লেন সময় মতোই ছাড়লো, আর ফ্লাইট ডিসটান্স বেশি না হওয়ায় মোটামুটি পৌনে দুই ঘন্টার মধ্যেই আমরা নাপোলির আকাশে পৌঁছালাম। আকাশ থেকে পাহাড় আর নীল সমুদ্র্র দেখছিলাম। নাপোলির বিখ্যাত সমুদ্র সৈকত আর বন্দরও চোখে পড়লো। একটু পরেই প্লেন নীচে নামা শুরু করলো। ঠিক ল্যান্ডিংয়ের আগ মুহূর্তেই দেখি প্লেন আবার আকাশে ওড়া শুরু করলো। আমরা সবাই অবাক। কি হলো? আমি পাশে বসা আমার স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাচ্ছি। আশেপাশে দেখি সবার মুখ গম্ভীর। এসময় পাইলট ঘোষণা করলেন যে নামার সময় বাতাসের বেগে কোনো গন্ডোগোল ছিল। কোনো ঝুঁকি না নিয়ে তিনি প্লেন আবার আকাশে তুলেছেন। একটু সময় নিয়ে প্লেন আবার নামবে। বাকি সময়টুকু আমরা টেনশনেই থাকলাম। তবে এবার কোনো বিপত্তি ছাড়াই প্লেন মাটিতে নামলো। আমরা স্বস্তির নি:শ্বাস ফেললাম।
বিমানবন্দরে নেমে আমরা সোজা তথ্যকেন্দ্রে গেলাম হোটেলে কিভাবে পৌঁছাবো তা বুঝতে। হোটেল বুক করেছি বুকিং ডট কমে। নাপোলি নতুন শহর। এরকম পরিস্থিতিতে আমরা সাধারণত ট্যাক্সি ভাড়া করি। তথ্যকেন্দ্রের ভদ্রমহিলা বললেন, তোমরা কেন ট্যাক্সি নেবে। বিমানবন্দরের বাইরেই বাস আছে। সেই বাস যেখানে থামবে সেখানেই তোমাদের হোটেল। আমরা বাস ধরলাম। বাস ঘন্টাখানেক পর আমাদের নামিয়ে দিলো। আরেক জনের সাহায্য নিলাম হোটেল কোথায় তা বুঝতে। উনি যে পথ ধরে যেতে বললেন সে পথ ধরে গিয়ে একটা হোটেল পেলাম বটে তা আমাদের দেশের চিৎকাত হোটেলের মতো। ঢোকার পথ দেখেই লুবনার মুখ কালো। হোটেলের রিসেপশনে গিয়ে বুঝলাম লোকেশন ভুল হয়েছে। রিসেপশনের স্টাফ আমাদের সাহায্য করলেন কিভাবে আমাদের হোটেলে যেতে হবে। আমাদের হাতে ইন্টারনেটে ডাউনলোড করা ম্যাপ। সেই ম্যাপ ধরে আরো মিনিট পনেরো হেঁটে আমরা আমাদের হোটেলে পৌঁছালাম। এতে একটা লাভ হলো। খুব দ্রুতই আমরা আমাদের হোটেলের আশেপাশের এলাকাটা সম্পর্কে একটা ধারণা পেলাম। পৌঁছামাত্র হোটেলের তরুণ ম্যানেজার নিজেই আমাদের রুম দেখিয়ে দিলেন। রুমের দরজা খুলেই আমাদের নিয়ে গেলেন বারান্দায়। বললেন, ‘তাকিয়ে দেখো দূরে কি দেখা যায়?’ চোখ মেলে দেখি আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। এই সেই ভেসুভিয়াস। ম্যানেজার জানতে চাইলেন আমরা ভেসুভিয়াস দেখতে যাব কিনা। বললাম, ‘অবশ্যই যাবো এবং তোমার সঙ্গে কথা বলেই পরিকল্পনা চূড়ান্ত করব।’
পিজার শহর নাপোলি
আমরা উঠেছিলাম নাপোলির মূল রেল স্টেশনের কাছাকাছি একটা হোটেলে। পুরোনো ভবন। বিশাল বিশাল জানালা। পর্দা তুলে বাইরে তাকালেই মন ভালো হয়ে যায়। তবে সুযোগ সুবিধা আধুনিক। আমাদের পছন্দই হলো। হোটেলে একটু ফ্রেশ হয়েই আমরা বেরিয়ে পড়লাম শহরটা একটু ঘুরে দেখবো বলে। রিসেপশন থেকে একটা ম্যাপ আর আশেপাশে দেখার জায়গাগুলো বুঝে নিলাম। তরুণ ম্যানেজার এবার মনে করিয়ে দিলেন যে আমরা কিন্তু পিজার শহরে অবস্থান করছি। নাপোলির অথেনটিক পিজা যেন আমরা মিস না করি। ইতালীয় পিজা তো পৃথিবী বিখ্যাত। সেই পিজা কিন্তু নাপোলির হাজার বছরের ইতিহাসের অংশ। পিজা নাপোলিতে আসে গ্রিকদের হাত ধরে। আসলে এক সময় পিজা ছিল গরীবের খাবার। বড়লোকেরা পিজা দেখে নাক সিঁটকাতো। রাজা চতুর্থ ফার্ডিনান্ডের সময় পিজা বড়লোকদের মধ্যে জনপ্রিয় হতে শুরু করে। বিখ্যাত মার্গারিটা পিজার নামকরণ হয় স্যাভয়ের রাণী মার্গারিটার নামে। ১৮৮৯ সালে রাণী নাপোলি সফরে এসে এই পিজার প্রেমে পড়েন। তারপর থেকেই পিজা ইতালী এবং ইতালীর বাইরে ছড়িয়ে যায়। ধন্যবাদ দিতে হয় মার্গারিটাকে। ভাগ্যিস তাঁর পিজা ভালো লেগেছিলো।
নাপোলির পিজা কিন্তু এখনো তৈরি হয় কাঠ-খড়ির ওভেনে। মজার ব্যাপার হচ্ছে পিজার স্বকীয়তা বজায় রাখার জন্য এই শহরে ২০০৪ সালে বিশেষ এক আইন পাস হয়। পিজাতে “০০” কোয়ালিটির আটা, “০” টাইপের ইস্ট, প্রাকৃতিক মিনারেলসমৃদ্ধ পানি, ছোলানো টমেটো বা তাজা চেরি টমেটো, মোজারেলা চিজ, সামুদ্রিক লবন এবং এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েলে ব্যবহার বাধ্যতামূলক। আমরা হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম নাপোলির সবচেয়ে বিখ্যাত শপ পিজারিয়া দা মিশেল এ। পুরো শহরে শত শত পিজার দোকান, কিন্তু সব ভীড় যেন পিজারিয়া দা মিশেল এ। অনেক কষ্ট করে টোকেন সংগ্রহ করতে হলো। মাত্র দু’ ধরনের পিজার অপশন এই শপে। একটা হলো ক্ল্যাসিক মার্গারিটা যাতে থাকে চিজ, টমেটো সস আর মাঝে একটা পুদিনা পাতা। আর অন্যটা হলো আদার সুগন্ধযুক্ত টমেটোর সসে ভরা। কিন্তু এতে কোনো চিজ থাকে না। এর সঙ্গে ভূমধ্যসাগরীয় পিটা আর লাফ রুটির মিল আছে। আর স্বাদ তো স্বর্গীয়। এই স্বাদ শুধু নাপোলিতেই মেলে। প্রায় এক ঘন্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে অবশেষে আমরা পিজা পেলাম। মুখে দিয়ে অবশ্য মনে হলো যে কষ্টটা সার্থক হয়েছে। নাপোলির অথেনটিক পিজা বলে কথা! ভীড় দেখে আমরা ভেবেছিলাম এ আরেকটি টুরিস্ট আকর্ষণ ছাড়া কিছুই নয়। বেশির ভাগ সময়ই টুরিস্টরা যার পেছনে দৌঁড়ায় তা অথেনটিক হয় না। কিন্তু আমাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। এই পিজা না টেস্ট করে নাপোলি থেকে ফিরে আসলে তা একটা বড় বোকামীই হতো। লন্ডন আর হলিউডের কয়েক জায়গায় নাকি এই শপের শাখা রয়েছে। তবে নাপোলির মূল শপে পিজা খাওয়ার মজা নিশ্চয়ই ওসব জায়গায় মিলবে না। আর দাম – প্রতি স্লাইস মাত্র চার ইউরো। চাহিদার তুলনায় দাম কমই তো। এই শহরের আরেকটি বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় খাবার হলো স্প্যাগেটি। এটি খাওয়া হয় “রাগু” নামের সস মিশিয়ে।
নাপোলির পথে পথে
ইউরোপে এই জুনে ভ্রমণের সময় আমরা পরিকল্পনা করি নাপোলিতে ঘোরার। আমি নাপোলিকে চিনি মূলত: ম্যারাডোনার কারণে। নাপোলির মতো ছোট একটা ক্লাবকে কি করে ইউরোপের সেরা টিমে পরিণত করেছিল ম্যারাডোনা সেই গল্পের কথা ফুটবলপ্রেমীরা সবাই জানে। আর শহরের রাস্তায় ঘোরাঘুরির সময় মনে হলো ইউরোপের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের অনেক কিছুকেই ধারণ করে আছে নাপোলি। বর্তমানে রোম এবং মিলানের পর ইতালির তৃতীয় বৃহত্তম নগরী নাপোলি। প্রায় ১০ লাখ মানুষের এই নগর কাম্পানিয়া অঞ্চলের রাজধানী। ইতিহাস বলে গ্রীকরা প্রথম সহস্রাব্দে এই নগরীর পত্তন ঘটায়। এই নগরী কখনো পরিত্যক্ত হয়নি। রোমান আর গ্রীক সভ্যতার মিলন ঘটানোয় এই নগরীর একটা ভূমিকা ছিল। আর সেকারণে রোমানদের গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল নাপোলিকে ঘিরে। বিশ শতকের শেষের দিকে নাপোলির উত্থান ঘটে অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে। ইউরোপের প্রধান সমুদ্র বন্দর হিসেবেও নাপোলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে।
আমরা হাঁটতে থাকলাম নগরীর রাস্তা ধরে। দেখা মিললো বিভিন্ন সময়ে তৈরি হওয়া অনেকগুলো গির্জার। এর কোনো কোনোটি রূপান্তরিত হয়েছে জাদুঘরে। কোনো কোনোটিতে মানুষজন ঢুকছে উপাসনা করতে। বিশালাকৃতির এসব স্থাপত্যকীর্তি মধ্যযুগ, রেনেসাঁ এবং পরবর্তী সময়ের রীতির প্রদর্শন করছে। মুগ্ধতা নিয়ে আমরা হাঁটতে থাকলাম সিটি সেন্টারের দিকে। এই সিটি সেন্টার অনেক পুরোনো। বলা হয় এটিই ইউরোপের সবচেয়ে বড় সিটি স্কয়ার এবং ইউনেস্কো ঘোষিত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অংশ। পুরো স্কয়ারের স্থাপত্যরীতি মুগ্ধতা ছড়ানো।
পুরো স্কয়ারজুড়ে চলছিল নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। একপাশে চলছিল মিউজিক্যাল কনসার্ট। সেখানে দেখা মিললো আফ্রিকা, আরব, লাতিন আমেরিকা এবং ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে আসা অভিবাসীদের। এদের কেউ কেউ এসেছে বৈধভাবে, আবার কেউ কেউ এসেছে অবৈধভাবে। এই স্কয়ারেই তারা বসিয়েছে ছোট ছোট দোকান। পুলিশ আসলে কেউ কেউ দ্রুত সরে যাচ্ছে। আমাদের ভাব জমে গেল এক পাকিস্তানী দোকানদারের সঙ্গে। উনিই খবর দিলেন তিন গলি পরে ভেতরের এক রেস্টুরেন্টে সবচেয়ে ভালো কোয়ালিটির গরুর মাংস পাওয়া যায়। তারা নিয়মিত সেখানে খেতে যান। আমরা ডিনার করতে চলে গেলাম সেখানে। আবিষ্কার করলাম যে এক শ্রীলংকান এই রেস্টুরেন্ট চালান। অনেক দিন পর মশলা দেয়া খাবার খাবার পেয়ে আমরা মজা করে খেলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম পরের দিন আবার আসবো এখানে ডিনার করতে। কারণ এরই মধ্যে মালিকের সাথেও যে সখ্যতা গড়ে উঠেছে। একই শহরে একই দিনে আমরা খেলাম সেরা পিজা আবার খেলাম ঝাল ঝাল গরুর মাংস আর ভাত। এই না হলে কসমোপলিটান শহর! নাপোলি আসলেই বড় এক কসমোপলিটান শহর।
মুগ্ধতা আর বিষণ্নতার পম্পেই নগরী
পম্পেইয়ের নাম শুনলেই মনটা কেমন যেন করে ওঠে। আমরা যারা আশি বা নব্বইয়ের দশকে কৈশোর কাটিয়েছি, তাদের কাছে পম্পেই মানে সেবা প্রকাশনীর নিউজপ্রিন্টে ছাপানো পেপারব্যাক অনুবাদ ”দ্য লাস্ট ডেজ অফ পম্পেই’ আর বিটিভির সৌজন্যে মুভি অফ দ্য উইকে দেখা ধূসর বিষণ্নতার স্মৃতি। কেমন করে ভেসুভিয়াসের ফুটন্ত লাভার নীচে ধ্বংস হয়ে গেল একটা জ্বলজ্যান্ত শহর!
পরদিন সকাল ৮ টার সময় বেরিয়ে পড়লাম প্রাচীণ শহরটার উদ্দেশ্যে। ট্রেনে করে যেতে ৪০ মিনিটের মতো লাগলো। স্টেশনের সঙ্গে লাগোয়া পম্পেইয়ের প্রবেশপথ। পর্যটকদের ভালোই ভীড়। লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট করতে হয়। টিকেট নিয়ে এগিয়ে গেলাম প্রবেশপথের দিকে। পোর্টা মারিনা প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়লো ভাঙ্গা কিন্তু এখনো দাঁড়িয়ে থাকা দেয়ালগুলো, এখনো টিকে থাকা ছাদগুলো। ভেসুয়িাসের ছায়ায় ধ্বংসস্তুপের মাঝেও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীণ সভ্যতার নিদর্শন। এখানে দাঁড়িয়ে আমার দু’ধরনের বোধ হলো। একটি বিষণ্নতার – কোথায় হারিয়ে গেলো এই শহরের মানুষেরা? অন্যটি হলো মুগ্ধতার – আমরা আজ যে সভ্যতায় দাঁড়িয়ে আছি তা কিন্তু হাজার হাজার বছরের বিভিন্ন সভ্যতার ফসল। এ যেন চির প্রবাহমান এক নদী।
পম্পেই নগরীর ধ্বংসের ইতিহাস বিষণ্নতারই। ৭৯ খৃষ্টাব্দের ২৪ আগস্ট মাত্র ১২ ঘন্টার মধ্যে পুরো নগরটা চাপা পড়ে ভেসুভিয়াসের জ্বলন্ত লাভার নীচে। আর দশটা দিনের মতো সেদিনও একটা সুন্দর সকাল দেখেছিল পম্পেইবাসীরা। সকাল আটটার দিকে হঠাৎ জেগে ওঠে ভেসুভিয়াস। প্রথমে দেখা যায় ধোঁয়া। তখনো কেউ ভাবেনি কি সর্বনাশা কাণ্ড ঘটতে যাচ্ছে! দুপুর একটার দিকে পুরো শহর থর থর করে কাঁপতে থাকে। ছাদ থেকে খুলে পড়তে থাকে টাইলস। ভেঙ্গে পড়তে থাকে বিভিন্ন মনুমেন্ট। নগরবাসী ভয়ে এদিক সেদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। নগরের দিকে ক্রমাগত ছুটে আসতে থাকে শিলা আর ছাই। দুপুর তিনটার দিকে তা পরিণত হয় পাথর বৃষ্টিতে আর কামানের গোলার মতো ছুটে আসতে থাকে অগ্নিশিখা। ভেঙ্গে পড়তে থাকে সবকিছু। এরপর শুরু হয় এসিড বৃষ্টি। পুরো শহর জ্বলতে থাকে। রাত আটটা নাগাদ পুরো শহর পরিণত হয় ধ্বংসস্তুপে। ভেসুভিয়াস থেকে নেমে আসতে থাকে জ্বলন্ত লাভা। পরের দিন সকাল হতেই পুরো শহর চাপা পড়ে লাভার নীচে। দিনশেষে আর খুঁজে পাওয়া যায় না শহরকে। হারিয়ে যায় সমুদ্র বন্দর আর শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটা – পুরো ল্যান্ডস্কেপটাই পাল্টে যায় চিরতরে। ধারণা করা হয়, এতে মারা পড়ে ২ হাজারের মতো মানুষ।
তবে মন্দের ভালো হলো, যেহেতু ১৮ হাজারের মতো শহরবাসী কোনোরকমে পালিয়ে বেঁচেছে, কেউই তাদের সহায়-সম্পত্তি সরাতে পারেনি। আর সে কারণে প্রাচীণ এই রোমান শহরের জীবনযাত্রা বা সংস্কৃতি কেমন ছিল তার একটা ভালো ধারণা পেয়েছে প্রত্নতত্ত্ববিদরা। প্রত্নতাত্ত্বিক খননের পর প্রায় অবিকৃত অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করে কেমন ছিল সে সময়ের সংস্কৃতি আর অর্থনীতি।
রাস্তা ধরে একটু এগিয়ে গিয়ে চোখে পড়লো বাসিলিয়া। এটি ছিল নগরের আদালত প্রাঙ্গণ এবং মূল ব্যবসায়িক কেন্দ্র। এর ২৮ টি কলাম এখনো জেগে আছে। এই প্রাঙ্গণ মুখরিত থাকতো ব্যবসায়ী আর ব্যাংকারদের পদচারণায়। আরো কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর বেশ বিস্তৃত খোলা জায়গায় পৌঁছালাম। পম্পেই শহরের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই জায়গা। এটির নাম ফোরাম। এখানেই নগরের সব বড় বড় অনুষ্ঠান হতো। ফোরামের চারদিকে বিভিন্ন ধরনের ভবন, ধর্মীয় এবং প্রশাসনিক দুই ধরনের ভবনই রয়েছে। অনেকগুলো মনুমেন্টও দেখা গেল ফোরাম স্কয়ারে। ফোরাম কিন্তু এখনো তার প্রাচীণ কাঠামোর নিদর্শন ধরে রেখেছে। উত্তর-দক্ষিণমুখী মূল চতুষ্কোণা কাঠামোটি দৈর্ঘ্যে ৪৮২ ফিট আর প্রস্থে ১২৪ ফিট। স্কয়ারের দক্ষিণদিকের দেয়ালের সঙ্গে রয়েছে মার্বেল-খচিত তিনটা বড় হল – এগুলো আসলে দাপ্তরিক ভবন। এখানে বসতেন নগরের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। পশ্চিম দিকে ছিল শাকসবজি, ফলমূল আর বিভিন্ন খাবারের বাজার। এরই নীচের দিকে জুপিটারের মন্দির। ধারণা করা হয় যে এই মন্দির খৃষ্টপূর্ব ২ শতকে নির্মিত।
আরো এগিয়ে যাওয়ার পর আমরা ঢুকি একটি ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ডে, সেখানে দেখা মেলে ফোরাম বাথের। মানে গণ-গোসলের ব্যবস্থা। নারী-পুরুষের জন্য আলাদা ব্যবস্থা। ঠান্ডা এবং গরম – দু’ধরনের গোসলের ব্যবস্থাই ছিল। ফোরাম বাথের দেয়ালে যে রং এবং দৃশ্যাবলী চিত্রায়িত তার সঙ্গে নাকি নীল-নদের অববাহিকার মিল পাওয়া যায়। হয়তো এই শহরের অনেকেরই আদিবাস ছিল নীল অববাহিকায়।
ফোরাম বাথের পর আমরা গেলাম এক ধনী ব্যবসায়ীর বাসা দেখতে। এই বাসার নাম ‘হাউস অফ স্যালাস্ট’। শহরের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত এই বাসা থেকে বোঝা যায় কেমন ছিল রোমান ধনীদের জীবনযাপন। ছোট্ট একটা একটা করিডোর দিয়ে ভিতরে ঢুকেই বড় খোলামেলা একটি কামরা যার নাম এট্রিয়াম। ঘরে আছে প্রচুর আলো-বাতাস ঢোকার ব্যবস্থা। ছাদের মাঝের একটি অংশ খোলা রাখা হয়েছে। সেখান থেকে বৃষ্টির পানি পড়ে মেঝেতে রাখা এম্পুভিয়া নামের একটি টাবে। এই সংগৃহীত পানি পাইপের মাধ্যমে সরবরাহ করা হতো গৃহস্থালীর কাজে ব্যবহারের জন্য। বিভিন্ন ব্যবসায়িক অতিথিদের সঙ্গে দেখা করার জন্য একটি ঘর রয়েছে। অতিথিদের থাকার জন্য আলাদা ঘর। পরিবারের সদস্যদের জন্য ঘরতো আছেই। এরপর আরেকটি ছোট করিডোর পেরিয়ে দেখা মেলে বাসার ভেতরেই থাকা বাগানের। পম্পেই কিন্তু পাথর আর দেয়ালে ঘেরা একটা ঘনবসাতপূর্ণ নগরী ছিল। তাই হয়তো বাসার ভিতরে সবুজ বাগান করার চেষ্টা করা হয়েছে। বাগানটা বেশ লম্বা। এর শেষ মাথায় একটা রান্নাঘর দেখা যায়। পরিবারের সদস্যরা সেখান থেকে খাবার নিয়ে বাগানের মনোরম পরিবেশে ভোজন সেরে ফেলতো বলে ধারণা করা হয়। শীত এবং গরমকাল দুই সময়ের জন্য আলাদা আলাদা কক্ষ দেখা গেল। দেখা গেল পড়ার ঘর। চাকর-বাকরদের জন্য আলাদা থাকার ব্যবস্থাও ছিল। ঘরের দেয়ালে ব্যবহার করা হয়েছে মার্বেল স্ল্যাব আর মেঝেতে মোজাইক। ‘হাউস অফ স্যালাস্ট’ কিন্তু বিভিন্ন সময়ের স্মৃতি বহন করছে। বাড়ির মালিক সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির স্টাইলে পরিবর্তন এনেছিল, আর আমরা জানতে পারছি রোমান সভ্যতার বিভিন্ন সময়কে।
পম্পেই নগরীতে ছিল বেশ কয়েকটা বেকারীর সেটআপ। সেগুলো ঘুরে দেখা গেল বিভিন্ন ধরনের চুলা, নানা ধরনের রুটি আর খাবার তৈরির কারিগরী ব্যবস্থা। রাস্তার ধারেই টিকে আছে অনেকগুলো দোকান। এক গাইড দেখি একদল পর্যটককে বোঝানোর চেষ্টা করছে এগুলো ছিল সেই সময়কার ফাস্টফুডের দোকান। নগরীজুড়ে নাকি ১২০ মতো ফাস্টফুডের দোকান ছিল। দোকানগুলোতে ভেসুভিয়াসের কোল-জুড়ে উৎপাদিত আঙুর থেকে তৈরি ওয়াইন বিক্রি হতো। জনপ্রিয় এই ওয়াইন কিনতে দূর-দূরান্ত মানুষ আসতো এই শহরে।
এরপর দেখা মিললো পতিতালয়ের। পুরো নগরে প্রায় ২৫টি পতিতালয় চিহ্নিত করা গেছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বড়টি একটা দোতলা ভবন। এর নীচ তলায় পাঁচটা কক্ষ আর ওপর তলায় আরো পাঁচটা কক্ষ। ওপর তলায় একটা বড় কামরাও রয়েছে, সেটি বোধহয় পার্টি করার জন্য। ছোট আকারের কক্ষগুলোতে একটি করে পাথরের ডিভান দেখা যায়। আর দেয়ালজুড়ে যৌনকর্মের আঁকা বিভিন্ন ছবি। অন্যসব পতিতালয়ের মতো এখানেও রয়েছে শোষণ আর বঞ্চনার গল্প। এখানকার মেয়েদের ধরে আনা হতো উত্তর আফ্রিকা, এশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের দখলকৃত এলাকা থেকে।
নগরে দু’টো থিয়েটারের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর একটি আকারে ছোট। সেখানে কবিতা পাঠ, ছোট সঙ্গীতায়োজন এবং অভিনয় চলতো। আর বড়টি উন্মুক্ত ছিল প্রায় ৫ হাজার দর্শকের জন্য। সেখানে আয়োজন করা হতো নাটক এবং বড় ধরনের সঙ্গীত পরিবেশনার।
মূল শহর পেরিয়ে একটু বাইরে টিকে আছে রোমান সময়ের সবচেয়ে পুরোনো এম্পিথিয়েটারটি। খৃষ্টপূর্ব ৭০-৮০ শতকে এটি নির্মিত হয়। এর নাম ক্যাভেয়া। এতে ২০ হাজারের মতো মানুষের বসার ব্যবস্থা ছিল। এখানে গ্ল্যাডিয়টররা নিয়মিত লড়তো ভয়ানক সব প্রাণীর বিপক্ষে। ৫৯ খৃষ্টাব্দে ক্যাভেয়াতে নাকি পম্পেই আর নুসেরিয়া শহরের মধ্যে খেলাধুলা নিয়ে রীতিমতো দাঙ্গা লেগে যায়। এরপর নাকি অনেক দিন এখানে খেলাধুলা নিষিদ্ধ ছিল।
বের হওয়ার পর দেখা পেলাম অ্যাপোলোর মন্দিরের। খৃষ্টপূর্ব ছয় শতকে এটি নির্মিত হয় বলে ধারণা করা হয়। তবে বিভিন্ন সময় ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এই মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং নিয়মিতই মেরামত করা হয়। অনেক কিছুই তৈরি করা হয় নতুন আঙ্গিকে। তবে বর্তমান রূপটি খৃষ্টপূর্ব ২ শতকের। মন্দিরটির সামনের দুই কলাম পুরো দাঁড়িয়ে আছে, আছে কিছু সিঁড়িও।
টানা সাড়ে তিন ঘন্টার পরিভ্রমণ সেরে যখন আমরা বের হচ্ছি তখন মনে হলো ২০ হাজার মানুষের নানা প্রয়োজনকে মাথায় রেখে আজ থেকে ১৯শ বছর আগে কত গুছানোভাবে তৈরি হয়েছিল পম্পেই নগরী। সেই নগরীর পরিকল্পনায় রাখা হয়েছিল পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা, বৃষ্টির পানি ধরে রেখে তা সরবরাহের ব্যবস্থা, সামাজিক এবং রাজনৈতিক অনুষ্ঠানের জন্য খোলা জায়গার ব্যবস্থা, সবুজের জন্য বাগান এবং মূল শহরের বাইরে এম্পিথিয়েটার। প্রাচীণ নগরীর পরিকল্পনাবিদরা যে চিন্তা চেতনায় আধুনিক ছিল তা বলাই যায়। বিষণ্নতা আর ভালো লাগা এই দুই অনুভূতি নিয়েই আমরা বিদায় নিলাম ভেসুভিয়াসের ছায়ায় থাকা পম্পেই নগরী থেকে।
ভেসুভিয়াসের শিখরে
পম্পেই নগরীতে ঘুরাঘুরি শেষ করে দুপুর একটার দিকে ট্রেনে করে এসে নামলাম স্টেশনে। সেখানে দেখি বাংলাদেশের মতোই বাস কন্ডাক্টর চিৎকার করছে ‘ভেসুভিয়াস’, ‘ভেসুভিয়াস’ বলে। সময় নষ্ট না করে আমরা দ্রুত কাউন্টার থেকে টিকেট করে বাসে চড়লাম। বসলাম একেবারে সামনের সিটে যাতে চলার পথের পুরো দৃশ্য উপভোগ করা যায়। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই বাস রওনা দিল ভেসুভিয়াসের উদ্দেশ্যে। বাস শহর পেরিয়ে পাহাড়ি পথ ধরল মিনিট পনেরো পর। আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগুতে থাকলো বাস। পথের দু’ধারে সবুজ পাহাড়ি গাছগাছালী। পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে অপেক্ষা করছে বিস্ময়। কয়েকটি বাকে তো বাস থামানো হলো নিচের দৃশ্যগুলো দেখার জন্য। আমরা যতই উপরে উঠতে থাকলাম ছেড়ে আসা শহরের বাড়ি ঘরগুলোকে দূরের ছোট ছোট ম্যাচ বাক্সের মতো মনে হতে লাগলো। প্রায় এক ঘন্টা ভ্রমণের পর বাস এসে থামল সমুদ্রপৃষ্ট থেকে এক হাজার মিটার ওপরের পার্কিং স্পেসে। আমাদের ড্রাইভার জানালেন ঠিক আড়াই ঘণ্টা পর বাস সবাইকে নিয়ে ফেরত যাবে। এর মধ্যে যত পারো ঘুরে দেখো।
বাস থেকে নেমে দেখি বেশ খাড়া প্যাঁচানো একটা রাস্তা পাহাড়ের উপরের দিকে উঠে গেছে আর সারি বেঁধে লোকজন উপরে উঠছে। আবার অনেকে দেখি উপরে ঘোরাঘুরি শেষ করে নিচে নেমে আসছে। পাঁচ মিনিট হাঁটার পর বুঝতে পারলাম চূড়ায় ওঠা আমাদের মত অনভ্যস্ত সমতলের মানুষের জন্য সহজ হবে না। পাশে তাকিয়ে দেখি ৬৫ বছরের দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ঠিকই হাঁটছে। তাঁদের দেখে খানিকটা লজ্জা পেয়ে এবং উৎসাহিত হয়ে আমরা হাঁটা অব্যাহত রাখলাম। ১০ মিনিট হাঁটি, তারপর দু মিনিট দম নিয়ে নেই। দম নেয়ার সময় স্পর্শ পাই ঠান্ডা পাহাড়ী বাতাসের আর চোখ জুড়ে যায় নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে। আমাদের পথ কিন্তু ছাই আর ছোট ছোট পাথর দিয়ে ভরা। পুরো পথটাই গড়ে উঠেছে উৎসারিত লাভা জমে। পথের দু’ধারে লাভার ওপরেই দেখি নানা ধরনের সবুজ গাছ জন্মেছে। হলুদ আর ম্যাজেন্ডা রঙের অনেক ফুল চোখে পড়লো। পাহাড়ের গায়ে যেন হালকা নরম রঙের বাহার। লাভায় গড়ে ওঠা পুরো উপত্যকা জুড়ে এখন আঙ্গুরের বাগান। কে বলবে এই সবুজ ভেসুভিয়াস যখন জেগে ওঠে তখন শুরু হয় প্রলয় নাচন। আবার বছর বছর জুড়ে সেই লাভা যখন ঠান্ডা হয় সেখানে জন্মে সবুজ গাছপালা। গড়ে ওঠে সভ্যতা।
৫০ মিনিট হাঁটার পর আমরা পৌছলাম চূড়ার বেজ প্লাটফর্মে। সেখানে ছোট্ট একটা দোকানে পানীয় বিক্রি হচ্ছে। ওখানে বসে বসে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। পানি পান করলাম কয়েক বোতল। পিপাসায় বুকের ছাতি যেন ফেটে যাচ্ছিলো। তারপরে এগুলাম জ্বালামুখ দেখতে। কাছে গিয়ে দেখি পাহাড়ের মুখে বিশাল এক গর্ত। মনে হয় যেন বড় কোনো বোমা পড়ে গর্তটা তৈরি হয়েছে। প্রায় তিনশো পাঁচ মিটার গভীর এবং ছয়শো দশ মিটার গোলাকার গর্ত দেখে অনুমান করা কষ্ট এই আগ্নেয়গিরির ধ্বংস করার ক্ষমতা। এই জ্বালামুখ দিয়ে এক নাগাড়ে পঁচিশ মিলিয়ন কিউবিক মিটার লাভার উদগীরণ ঘটতে ঘটতে পারে যে কোন সময়।
ভেসুভিয়াস কিন্তু একটা ঘুমন্ত এবং সক্রিয় আগ্নেয়গিরি। সর্বশেষ এটি জেগে উঠেছিল ১৯৪৪ সালের ১৮ ই মার্চ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলার সময়। কাকতালীয়ভাবে সেদিনই আমেরিকার নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনী ইতালি দখল করে। কেউ কিন্তু জানে না আবার কখন এই আগ্নেয়গিরি জেগে উঠবে। পাদদেশে থাকা সাতাশটা পৌরসভার অভিবাসীরা জানেন তারা ‘রেড জোন’ এর মধ্যে আছে। সতর্ক সংকেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাদেরকে জরুরি ভিত্তিতে সরে যেতে হবে বাসাবাড়ি থেকে। ধারণা করা হয় প্রাগৈতিহাসিক সময়েও ভেসুভিয়াস সক্রিয় ছিল। আজ থেকে বিশ লাখ বছর আগে আগ্নেয়গিরিটি সক্রিয় ছিল সমুদ্রের নিচে। আজকের যে বড় কোনাকার চূড়া তার উত্থান হয় আজ থেকে চৌদ্দ হাজার বছর আগে। সবচেয়ে আলোচিত উদগীরণের ঘটনা ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ৭৯ সালে যাতে পম্পেইয়ের সাথে সাথে হারকিউলারিয়ান নামের আরেকটি শহর পুরো ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর অনেকদিন চুপ থাকে ভেসুভিয়াস। খ্রিস্টাব্দ ৪৭২ থেকে ১৫০০ সাল পর্যন্ত নিয়মিত জেগে ওঠার ঘটনা দেখা যায়। তারপর প্রায় একশ বছর কোন খবর নেই। ১৬৩১ একটি সালে ১৬ ই ডিসেম্বর আবার তার ঘুম ভাঙ্গে। উনিশ শতকের আগে চূড়ায় উঠার পাকা রাস্তাটি ছিল না। ১৯৪০ সালে ১০০০ মিটার ওঠার গাড়ি রাস্তাটি তৈরি করা হয়। অ্যান্টোনিও ম্যাট্রন নামের এক স্থানীয় ধনী ব্যক্তি রাস্তা তৈরীর পুরো খরচ বহন করেন। সহজ হয়ে ওঠে শিখরে ওঠা। রাস্তা যখন ছিল না গাধার পিঠে করে অনেকে উঠতেন ভেসুভিয়াস।
আমার কাছে জ্বালামুখ দেখার চাইতেও আকর্ষণীয় লেগেছে নাপোলি শহরের সমুদ্র সৈকতের অপূর্ব অপরূপ দৃশ্য পাহাড়ের ওপর থেকে দেখা। দেখা যায় লাভার ওপরে গড়ে ওঠা চাষাবাদ। চোখে পড়ে প্রসিডা আর ইসচিয়া দ্বীপের কিছু অংশ, লাট্টারি পর্বতমালা, ক্যাপরি দ্বীপ এবং সরেনটাইন পেনিনসুলা। দু’চোখ জুড়িয়ে যায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে। ১৯৯৫ সালের ৫ জুন সম্মা-ভিসুভিয়াস পর্বতকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। উদ্দেশ্য আগ্নেয়গিরির বিশেষ পরিবেশকে সংরক্ষণ করা। একে কিন্তু ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে আগ্নেয়গিরির ইতিহাস ভালোভাবে জানতে পারে সংরক্ষণের মূল উদ্দেশ্য তাই।
শিখরে ঘন্টাখানেক সময় কাটিয়ে আমরা নিচে নেমে এলাম। নামতেও প্রায় চল্লিশ মিনিট লেগে গেল। নামার সময় হাঁটুর জোরের পরীক্ষা দিতে হলো। তবে শারীরিক কষ্ট ছাপিয়েও মনে জায়গা করে নিয়েছে একটি ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ দেখার অভিজ্ঞতা আর তাকে ঘিরে থাকা অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য। এ যেন ধ্বংস আর সৌন্দর্যের চিরায়ত দ্বন্দ্বের প্রতিচ্ছবি।
নাপোলির হাসিখুশির সংস্কৃতি
এই ভ্রমণে একটা বিষয় উল্লেখ না করলে নাপোলির সংস্কৃতির একটা বড় দিক বাদ পড়ে যাবে, এই নগরীর সবচেয়ে বড় শক্তি হলো প্রাণোচ্ছ্বল মানুষগুলো। ভীষণ আড্ডাবাজ আর অসাধারণ মিশুক মানুষগুলো সহজেই সকলকে আপন করে নেয়। বোঝা যায় কেন ম্যারাডোনা সারা ইউরোপ ছেড়ে এই নগরীর প্রেমে পড়েছিলেন। আর মানুষগুলোও এখনো তাঁকে মনে রেখেছেন। সফরের একটা উদাহরণ দিয়ে লেখাটা শেষ করছি। পম্পেই থেকে ট্রেনে করে ফেরার সময় আমরা ভুল করে আগের স্টেশনে নেমে যাই। বোঝার চেষ্টা করছিলাম পরের ট্রেনটা কত পরে। ছোট সেই স্টেশনে আমরা বাদে আর একজন মাত্র মানুষ। এক বয়স্ক মহিলা। আমার স্ত্রী তাঁর দিকে এগিয়ে গিয়ে ইংরেজিতে জানতে চাইছিলেন পরের ট্রেন কখন। স্থানীয় ভাষায় উনি কি উত্তর দিলেন তা তো বোঝার উপায় নাই। একটু পরে দেখি দুইজন দুই ভাষায় কথা বলছেন আর হাসাহাসি করছেন। আমি তো অবাক। কারণ কেউই কারো কথা বুঝছেন না। শারীরিক এক্সপ্রেশনেই ভাবের আদান প্রদান চলছে। এরমধ্যে হাজির এক তরুণী। সে ইংরেজিটা বোঝে। সে হয়ে গেল দোভাষী। কিছুক্ষণের মধ্যেই এদের তিনজনের মধ্যেই তৈরি হয়ে গেল বন্ধুত্ব, এমনকি ঠিকানা বিনিময়। এটা বোধহয় নাপোলিতেই সম্ভব। জানি না এই করোনাকালে কেমন আছেন সেই মানুষগুলো। এখনো কি তারা প্রাণ খুলে হাসেন? এখনো কি তারা পরকে দ্রুত আপন করে নেন? আশা করি করোনা পরবর্তী নাপোলি তার হাশিখুশি আর বন্ধুত্বের সংস্কৃতি বজায় রাখবে। পৃথিবী আবার আগের মতো হবে।
আনোয়ারুল হক।