সিকিম বেড়িয়ে ফেরার পথে এক রাতের জন্য থেমেছিলাম কালিম্পঙে। উঠেছিলাম দিনাজপুরের রাজার বাড়িতে যা কিনা এখন একটি বুটিক গেস্ট হাউজ। নাম তার কালিম্পঙ পার্ক হোটেল। পুরোনো কাঠামো বজায় রেখে আধুনিক ব্যবস্থাপনা। চাকুরিসূত্রে কিছুদিন দিনাজপুরে থাকতে হয়েছিল। দিনাজপুরের রাজবাড়িতে যাওয়া হয়েছিল বেশ কয়েকবার। দুর্গাপুজার সময় রাজার বাড়ি থেকে নদীপথে কিভাবে প্রতিমা যেত কান্তজি’র মন্দিরে সেই সব কাহিনী শুনেছি লোকমুখে। সেই রাজারই বাড়িতে কালিম্পঙে থাকছি – একটা বাড়তি রোমাঞ্চ তো আছেই। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গৌরিপুর লজ দেখার আগ্রহ। সেই গৌরিপুর লজ যেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ৭৮তম জন্মদিন পালন করেছিলেন ১৩৪৫ বঙ্গাব্দের ২৫ শে বৈশাখ। আমার স্ত্রী লুবনা এর আগে একবার কালিম্পঙে এসে সেই গৌরিপুর লজের সামনে থেকে ঘুরে গেছে, কিন্তু ভেতরে ঢোকা সম্ভব হয়নি। ভোরবেলা আমাদের প্ল্যান সেই লজ ঘুরে দেখার।
খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে দাঁড়িয়েছি রুমের সঙ্গে লাগোয়া বারান্দায়। পরিস্কার আকাশ। সামনে হিমালয়ের ঘাড়ের উপর সূর্য উঠছে। চারিদিকে নাম না জানা পাখির কলকাকলি। অন্ধকার কেটে আলোকিত হয়ে উঠছে ভোরের কালিম্পঙ। রাতে বোঝা যায় নি পরিবেশ কতটা সবুজ। বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখি আকাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কাঞ্চনগঙ্ঘা। সত্যি সত্যিই অনেক দিন পর এই ভোরে মনের চনমনে ভাব নতুন করে জেগে উঠলো। এই পরিবেশে নিজের অজান্তেই আওড়াচ্ছি রবীন্দ্রনাথের তরুণ বয়সের কবিতা “নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ”,
“আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের পর,
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাতপাখির গান!
না জানি কেন রে এত দিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ।”
তখন মনে হলো এটাই সঠিক সময় গৌরিপুর লজ ঘুরে দেখার।গেস্ট হাউজ থেকে বেরিয়ে হাতের ডানে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপরে উঠতে থাকলাম। কালিম্পঙ শহরের দক্ষিণে গৌরিপুর লজ। রিং কিং পিং রোড ধরে যেতে হয়। গৌরিপুর লজের পাশেই কালিম্পঙের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট। রাস্তা ধরে এগুতেই বুঝলাম কেন কালিম্পঙ উত্তরাঞ্চলের অন্য জনপদগুলো থেকে আলাদা। রাস্তার দু’ধারে অনেক বাড়িঘর। তারপরেও পুরো রাস্তাজুড়ে এক ধরনের নিস্তব্ধতা। সবুজ গাছগাছালির ডালপালায় উঁকি দিচ্ছে নানা রঙের পাখি। ভেসে আসছে তাদের ডাক। বড় বড় গাছের পাতার ফাঁক গলে বেরিয়ে আসছে সূর্যের কিরণ। একটু এগুতেই ডানে একটা বাঁক ধরে আমাদের নামতে হলো। এরই মধ্যে ভেসে আসা মেঘ কুয়াশাচ্ছন্ন করলো চারিদিক। আরও একটু এগুতেই রাস্তার ধারে দেখতে পেলাম পুরোনো একটা বাড়ি। দু’ধারে বেশ জায়গা রেখে বানানো দোতলা বাড়ি। সত্যি বলতে কি রোদ আর কুয়াশার মাঝে দূর থেকে বাড়িটাকে ভুতুড়েই মনে হলো। কোনো এক ভৌতিক বাংলা শর্ট ফিল্মের শুটিংও নাকি হয়েছে এই বাড়িতে। আহা, এই সেই গৌরিপুর লজ যেখানে রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন “মনবিশ্রামের জন্য”।
মূল রাস্তা থেকে একটা সরু রাস্তা নেমে গেছে গৌরিপুর লজে। চারপাশে কোনো জনমানবের দেখা নেই যে আলাদা করে ভেতরে ঢোকার অনুমতি নেব। নিজ দায়িত্বেই আমরা এগিয়ে গেলাম। সামনে থেকে পটাপট বেশ কয়েকটা ছবিও তুললাম। ভবনের সামনে গিয়ে দেখি মার্বেল পাথরের একটি ফলকে লেখা “এই ভবনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাস করিতেন এবং ২৫ শে বৈশাখ ১৩৫৪ সনে ‘জন্মদিন’ কবিতা আকাশবাণীর মাধ্যমে আবৃত্তি করিয়াছিলেন।” ইতিহাস বলে রবীন্দ্রনাথের ৭৮তম জন্মদিনে সন্ধ্যাবেলায় আকাশবাণী কোলকাতা কেন্দ্র টেলিফোনের মাধ্যমে কবির সঙ্গে যুক্ত হয়। বিশ্বকবি তার সদ্য লেখা কবিতা “জন্মদিন” আবৃত্তি করেন সেই সন্ধ্যায়। আর তা পুরো ভারতবর্ষে প্রচারিত হয় বেতার তরঙ্গে। এর আগের রাতে কালিম্পঙে নাকি বড় একটা ঝড় হয়েছিল। টেলিফোনের অনেক খুঁটি আর তার উপড়ে পড়েছিল ঝড়ের কারণে। বেতার আর টেলিফোন বিভাগের কর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই নাকি এই প্রচার সময়মতো করা সম্ভব হয়েছিল। আর রবীন্দ্রনাথের এই আবৃত্তির সঙ্গেই সূচনা হয় কালিম্পঙ আর কোলকাতার মধ্যকার প্রথম সরাসরি টেলিফোন যোগাযোগের। চোখে পড়লো এক মধ্য বয়স্ক নারী বাড়ির দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। আমাদের দেখে তিনি এগিয়ে এলেন। খারাপ লাগলো এই ভেবে যে তার অনুমতি না নিয়েই তার ব্যক্তিগত স্পেসে ঢুকে পড়েছি। কথা বলতেই অবশ্য সেই জড়তা কেটে গেল। উনিই এখন এই বাড়ি দেখাশোনা করেন। ওনার বাবা সম্ভবত এই বাড়ির কেয়রটেকার ছিলেন। বাংলাদেশ থেকে এসেছি জেনে আমাদের ভেতরে নিয়ে গেলেন। সঙ্গে থেকে ঘুরিয়ে দেখালেন পুরো বাড়িটা। ডানদিকে শোবার ঘরের সঙ্গেই লাগোয়া এক বারান্দা। বারান্দার সামনে খোলা আকাশ যেখানে দেখা মেলে দূরের পাহাড়ের গায়ে থমকে থাকা মেঘমালার। পরিস্কার আকাশে দেখা মেলে কাঞ্চনজঙ্ঘা আর নাথুলা পাহাড়ের অপরূপ শোভার। “মন বিশ্রামের জন্য” এর চেয়ে ভালো স্থান আর কিই বা হতে পারে?
গৌরিপুর লজের আসল মালিক ছিলেন বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার গৌরিপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী। ১৯৩৮ সালের ২৫ শে এপ্রিল যখন বিশ্বকবি প্রথম কালিম্পঙ যান তখন তার থাকার জন্য বাড়িটি ফাঁকা করে দেন জমিদার নিজেই। জীবনের শেষভাগে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ কালিম্পঙ আসেন চারবার। এতো জায়গা থাকতে জীবন সায়াহ্নে বেশ কয়েকবার কেন তিনি কালিম্পঙে এসেছিলেন এ নিয়ে বেশ কৌতুহল বোধ করি এবং একটু ঘাটাঘাটি করতেই এর উত্তর পেয়ে যাই। আমরা জানি যে জোড়াসাঁকো, শিলাইদহ আর শান্তিনিকেতন এই তিনটি স্থান কবির জীবনকে অনেক প্রভাবিত করেছে। এর বাইরে পাহাড় তাঁকে বিশেষভাবে টানতো। তাঁর প্রথম হিমালয় দর্শন বাবা দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে সেই বালককালে। এরপর বাইশ বছর বয়সে বড় ভাই আর বৌদি কাদম্বরী দেবীর সঙ্গে তিনি ট্রয় ট্রেনে করে প্রথম দার্জিলিং যান। তারপর কখনো তিনি গিয়েছেন মেঘের জনপদ শিলংয়ে। ত্রিপুরার রাজার সঙ্গে তার ছিল বিশেষ বন্ধুত্ব। তাঁর আমন্ত্রণে গেছেন রাজধানী আগরতলায়। ঝর্ণাস্নাত তিনধারিয়া, পাহাড়-কণ্যা দার্জিলিং বা নানা স্মৃতিতে ভরা মংপু – এ সব জায়গায় তিনি সুযোগ পেলেই গিয়েছেন। কালিম্পঙ তাঁর কাছে ছিল নীল নির্জনে সময় কাটানোর স্থান। বলা যায় সব কিছু থেকে পালিয়ে নিজের মনকে আলাদাভাবে সময় দেওয়ার সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন কালিম্পঙে। কেন তিনি কালিম্পঙ পছন্দ করেন এর বর্ণনা পাওয়া যায় ১৯৩৮ সালের ৩০ এপ্রিল জমিদার ব্রজেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর মেয়ে হেমন্তবালা দেবীর কাছে লেখা চিঠিতে। তিনি লেখেন, “এখনো পর্যন্ত কালিম্পঙের দুর্নামের যোগ্য কোনো লক্ষণ দেখিনি। দার্জিলিংয়ের চেয়ে ভাল, যেহেতু শুকনো। শিলংয়ের মত এখানে কেরাণী এবং কেরাণীপ্রভুদের আবহাওয়া নেই। ভারত শাসন কর্তাদের রথচক্রের ঘড়ঘড় এখানে কানে আসে না।” এসবের পাশপাশি স্থানীয়রাও বিশ্বকবির ব্যাপারে ছিলেন অনেক সংবেদনশীল। তারা জানতেন কবির শরীর ভাল না এবং কবি একটু নির্জনতার খোঁজেই কালিম্পঙে আসেন। ফলে কবিকে তারা একা থাকার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। শুধু ১৯৩৮ সালের পহেলা মে স্থানীয় অধিবাসীরা গৌরিপুর লজেই তাকে অনাড়ম্বর পরিবেশে এক নাগরিক সংবর্ধনা দেয়। কবি সেই অনুষ্ঠান উপভোগ করেন। সবার সঙ্গে ছবিও তোলেন।
৭৮তম জন্মদিন গৌরিপুর লজে পালন করা তিনি বেশ উপভোগ করেছিলেন মূলত অনাড়ম্বরতার কারণে। সেদিন সকালেই মৈত্রেয়ী দেবী মংপু থেকে চলে আসেন কবির সঙ্গে দেখা করতে। আনন্দিত হয়ে কবি মৈত্রেয়ী দেবীর কাছে জানতে চান কবিতা লিখেছেন কিনা। হাসতে হাসতে বলেছিলেন কলম হাতে নিতে। লিখতে বলেছিলেন “হে রবীন্দ্র, হে কবিন্দ্র” টাইপের কিছু।
গৌরিপুর লজেও কবির সময় কেটেছিল ব্যস্ততায়। চোখের জ্যোতি কমে আসছিল। শরীরও করছিল বিদ্রোহ। তারপরও তিনি শান্তিনিকেতন থেকে আসা “গীত বিতান” এর প্রুফ দেখেছিলেন। তখন চলছিল “গীতবিতান” এর ছাপার কাজ। এই লজেই তিনি করেছিলেন “সেঁজুতি” কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত কবিতা রচনার কাজ। তার “পত্র সংকলন” এর সম্পাদনাও করেছিলেন এখানে বসে।
১৯৪০ সালের ২১ এপ্রিল কবি আবার কালিম্পঙে আসেন ভগ্ন- হৃদয় নিয়ে। কোলকাতা ছাড়ার আগে মৃত্যু বরণ করেন কবির কাছের মানুষ দিনবন্ধু এন্ড্রুজ। গৌরিপুর লজে বসেই খবর পান তাঁর আরেক প্রিয় মানুষ ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথের প্রয়াণের। এইসব ব্যক্তিগত শোকের সঙ্গে যুক্ত হয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে চলা সভ্যতার সংকটের। বৈশ্বিক বিপন্নতায় মাসনিকভাবে বিপন্ন বোধ করেন কবি। ১৯৪১ সালের ১৫ জুন তিনি চিঠি লেখেন তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে। অগ্রণী ভূমিকা রাখতে বলেন সভ্যতার এই সংকট নিরসনে।
গৌরিপুর লজে সবশেষ কবি আসেন ১৯৪০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর। তাঁর শরীর তখন মোটেই ভালো নয়। ডাক্তাররা বারণ করলেন। কিন্তু তিনি ফিরলেন কালিম্পঙে। কোলকাতা ছাড়ার আগে তিনি কবি অমীয় চক্রবর্তীকে চিঠিতে লিখলেন, “ভারতবর্ষে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে পালিয়ে থাকা যায়। ভিতরের যন্ত্রগুলো কোথাও কোথাও বিকল হয়ে গেছে। বিধান রায় কালিম্পঙে যেতে নিষেধ করেছিলেন। মন বিশ্রামের জন্য এমন ব্যাকুল হয়েছে যে তাঁর নিষেধ মানা সম্ভব হল না।” কবি বুঝতে পারছিলেন সামনে কোনো বিপদ আছে। সময় ঘনিয়ে আসছে। এবার গৌরিপুর লজে তাঁর দেখাশুনার ভার নিলেন ছেলের স্ত্রী প্রতিমা দেবী। কবি তাকে বলেছিলেন যে ডাক্তাররা বিপদের আশঙ্কা করছেন। এসময় প্রতিমা দেবীর মতো কাছের মানুষ পাশে থাকাই ভালো। আসার পাঁচদিন পর ২৫ সেপ্টেম্বর কবি কিডনির রোগে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে জরুরী ভিত্তিতে কোলকাতা নেয়া হয়। তিনি আর সুস্থ হননি। তাঁর মহাপ্রয়াণ যাত্রার শুরুও কি তাহলে কালিম্পঙে?
কবির শোয়ার ঘরের সঙ্গে লাগোয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিলাম। রোমাঞ্চিত হচ্ছিলাম এই ভেবে যে একই বারান্দায় কবিও দাঁড়াতেন এভাবেই হয়তো আকাশ দেখতেন। এই আকাশ, এই পাহাড়, এই পরিবেশ – সব নিয়েই তো কবির কালিম্পঙ:
“এই পাহাড়ে নীলে আর দিগন্তের নীলে, শুন্যে আর ধরাতলে, মন বাঁধে ছন্দে আর মিলে। বনেরে করায় স্নান শরতের সোনালী। মাঝখানে আমি আছি, চৌদিকে আকাশ তাই নি:শব্দে দিতেছে করতালি। আমার আনন্দে আজ একাকার ধ্বনি আর রঙ, জানে তাকে এ কালিম্পঙ।” (বরণ, কবি অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা চিঠির কবিতা)
আনোয়ারুল হক।